বিজয় দিবস

ভালো থাক প্রাণের বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!

আমার সোনার বাংলাদেশ আর অল্প কিছুদিন পরই পঞ্চাশে পা রাখতে যাচ্ছে। সেই সুবর্ণজয়ন্তির দিনটা যদি এমন হতো, সবাই সবার হাত ধরে হাঁটছে, সবার মুখেই ভালোবাসার আকুতি প্রভাত সূর্যের মতো মোলায়েম আলো হয়ে ফুটে উঠছে, অন্ধকার মুছে ফেলে প্রাগ্রসর চিন্তায় শান্তির ভবিষ্যৎ আঁকছে সবাই। এমন একটা দিনের স্বপ্ন আটচল্লিশের এই বিজয়ের দিনেই দেখে ফেলি আসুন। হাহাকার-আহাজারি-রক্তনদীর হাজার ট্র্যাজেডি, এক সাগর দুঃখবোধ কিংবা অজস্র বেদনার গল্পগাথা পেছনে ফেলে সাফল্যের আশাবাদে সবার আগে রাখা থাক প্রাণের বাংলাদেশ। সর্বৈব শুভ হোক মহান বিজয় দিবস। আমরা ভালো থাকি দেশটাকেও আগলে রাখি।

এবারের বিজয় দিবসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভরা মৌসুম চলছে। নতুন বছরে নতুন সরকারের হাতে আমরা দায়িত্ব অর্পণ করব। পুরোনো খোলস বদলে সেই সরকার নিশ্চিতই অধিকতর জনবান্ধব হয়ে ওঠবে। এমন সরকার কি আমরা গড়তে পারব, যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করবে না, যারা মাদক ব্যবসায়ীদের নিজেদের দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে রেখে ক্ষমতাচর্চা করার সুযোগ দেবে না, যারা জনগণের টাকায় নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়বে না? আমরা জানি বেশি কিছু আশা করা ভুল। তবু আশাবাদকে আমরা অবদমনের বিষক্রিয়ায় ফেলতে চাই না।

নানামুখী শঙ্কা এখনো আছে। ভোটাররা কি নির্বিঘ্নে-নিঃশংসয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে? ভোট দিতে পারলেও কি তাদের মনমতো প্রার্থী বিজয়ী হতে পারবে? অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এবারের সংসদে নির্বাচনে বরাবরের মতোই প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকা অনেকেরই অর্থকড়ির হিসাবে বেশ বাড়বাড়ন্তই দেখা গেছে। কারো কারো সম্পদ ১০ বছরে ২০০-৩০০ গুণ বেড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে ভাবা যেতেই পারে জাতীয় সংসদকে এঁরা মানিমেশিন হিসেবেই ধরে নিয়েছে। সেই তারা যদি আবার ওই মহামহিম চেয়ারের স্বাদ পান এবার তাদের আঙ্গুল ফুলে বটবৃক্ষে রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। সেই বটবৃক্ষের ছায়াতলে আরো ধুরন্ধররা কি আশ্রয় পাবে না?   

আমরা এমন মাটির মানুষদের কবে খুঁজে পাব যারা জনসেবা বা দেশের উন্নয়ন করতে গিয়ে অর্থসম্পদের দিক থেকে নিজেকে নিঃস্ব করে দেবে? যদি পাওয়া যেত তবে অনেক অশান্তিরই অবসান হতো। অন্তত অর্থবিত্তের জন্য খুনোখুনি-হানাহানি আর জিঘাংসার অপনোদন ঘটত। বিজয়ের এই দিনে আমরা ভোগবাদী নয় ত্যাগী মহামানবদেরই গুণকীর্তন করব, যাদের কাছে দেশসেবা ও মানবাধিকার রক্ষার সদিচ্ছাটাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। লোভ আর লাভালাভের পাপ নয় সবাইকে নিয়ে সুখী থাকবার পুণ্য সর্বান্তকরণে যাদের স্পর্শ করে থাকে তারাই হোক আমাদের আদর্শ। কেবল চাওয়া নয় সবার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা জাগবে যেদিন, সেদিন বাংলার নীলাকাশে সাম্যের সফেদ কপোত উড়বে। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টা তবেই না ফলপ্রসূ হতে পারে। আমাদের ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। লাখো শহীদের প্রাণ আর মায়ের সম্ভ্রমের মহামূল্য ঘুচিয়ে যে দেশ মাতৃকাকে পাওয়া তাঁকে পেছন ফিরবার ভাবনা কখনোই পেয়ে বসতে পারে না। আসুন কর্তব্যনিষ্ঠার মশাল জ্বেলে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলি। সঠিক পথের আলোতে একলা রাতের অন্ধকার ঘুচাই।

মানবাধিকার হরণ, দারিদ্র্য, কূপমণ্ডুকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে নিশ্চিতই যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে এবং আমাদের এই প্রত্যাশা থাকবে যে একদিন এই বাংলাভূমে চূড়ান্ত বিজয় আসবে আলোর ভোর হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অন্যতম চেতনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে কিছুটা হলেও পিছু হটছে। এখনো পথে-প্রান্তরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে জোরেসোরে একশ্রেণির ধর্মান্ধ মৌলবাদীগোষ্ঠী অপর ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়ায়, নারীর সমঅধিকারে বিশ্বাস না করে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ায়। নারীকে ঘরে বন্দি করে পুরুষের দাসি বানিয়ে রাখতে ধর্মীয় দফা বাস্তবায়নের আলটিমেটাম দেয়। একাত্তরে পরাজিত সেই অপশক্তি দেশটাকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো ধর্মরাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখে। মধ্যযুগীয় ব্লাসফেমি আইনও চায়। তারা এসব কাজে একালের সোশ্যাল মিডিয়াকেও হাতিয়ার করেছে। উত্তরাধুনিক এই যুগে এটা চরম মানবতাবিরোধিতারই নামান্তর। আগামীতে নতুন সরকারে যারা আসবে তারা কি সব কৌশলী রাজনীতি ভুলে জাতি ধর্ম গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলবে?

কবি হেলাল হাফিজ ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় লিখেছেন, কথা ছিল একটি পতাকা পেলে পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে। কথা ছিল একটি পতাকা পেলে ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে, বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে। কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমাদের সব দুঃখ জমা দেব যৌথ-খামারে, সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ সকলেই নিয়ে যাব নিজের সংসারে। কবিকল্পিত এমন সুখের সংসারের স্বপ্নই তো আমরা বরাবর দেখে এসেছি।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের গর্বের অর্জন। সেই মহান বিজয়কে সমুন্নত রাখতে দেশমাতৃকার প্রতি আমাদের দায়বোধ থাকা উচিত সবকিছুর আগে। যে মাটিতে আমাদের প্রাণের শিকড় পোতা সেই মাটির কান্নায় হৃদয়কে আর্দ্র হতেই হবে। আমরা আর তমসাঘন রজনী দেখতে চাই না। আপনঘরে গৃহহারা হয়ে কাঁদতেও চাই না। দেশ আমাদের মা। সেই দেশমাতার কাছে বড় আশা করে আত্মনিবেদন করলে তিনি দীনহীন আমাদের নিশ্চয়ই ফেরাবেন না। আজ বিজয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আরেকবার দেশমাতার জন্য রাখা থাক এই রাবীন্দ্রিক আরতি-

আর আমি- যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব।

আর আমি- যে কিছু চাহি নে, জননী বলে শুধু ডাকিব।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন