নির্বাচন

ইশতেহারের এপিঠ-ওপিঠ

Looks like you've blocked notifications!

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য, নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান, পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেওয়া, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছাড়া সব ধরনের কোটা তুলে দেওয়াসহ ১৪টি প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে, তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখা। সেইসঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলাকারীদের বিচারের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে।

খুবই ভালো ভালো কথার সমাহার ঐক্যফ্রন্টের এই ইশতেহার—যেখানে প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয়, বরং জাতীয় ঐক্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম চিরতরে বন্ধ, ব্যাংকিং খাতে লুটপাটে জড়িতদের বিচার এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিতে তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের কথাও বলা হয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব বা এসব বাস্তবায়নের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের প্রয়োজন, তা এ মুহূর্তে বিদ্যমান রয়েছে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্নবোধ চিহ্ন।

সোমবার (১৭ ডিসেম্বর ২০১৮) রাজধানীর হোটেল পূর্বাণীতে এই ইশতেহার ঘোষণার পরদিন, আজ মঙ্গলবার, সোনারগাঁও হোটেলে ইশতেহার ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ—যেখানে প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে লোক নিয়োগ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী, নগর ও শহরে পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করা, প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। ইশতেহার ঘোষণার শেষ দিকে তিনি বিগত দিনে তার সরকারের আমলে কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখারও আহ্বান জানান। বলেন, অতীতে থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণই তার দলের লক্ষ্য।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংখ্যালঘুদের আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের কথা বললেও আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠন এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তির যেসব ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে বলে জানান শেখ হাসিনা।

ইন্টারনেট দুনিয়ায় গুজব নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া, এ সম্পর্কিত আইনের অপ্রয়োগ বন্ধ করা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় উৎসাহ দেওয়া, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমবান্ধব আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে। এখানে আইনের অপপ্রয়োগ বলতে যদি তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা বুঝিয়ে থাকে, তাহলে এটি খুবই ইতিবাচক এ কারণে যে এর আগেও দেখা গেছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার কী ভীষণ অপপ্রয়োগ হয়েছে। সেই বাস্তবতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলেও এ বিষয়ে নাগরিকের উদ্বেগ যে কমেছে, এমনটা বলা যাবে না।

যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সংশয় আছে যে তারা ক্ষমতায় গেলে আদৌ এই আইন বাতিল করবে কি না? কারণ এটি বিরুদ্ধ মত দমনের হাতিয়ার। সব সরকারই চাইবে তাদের বিরোধী মত এই প্রক্রিয়ায় দমন করতে। যার বড় উদাহরণ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। বিরোধী দলে থাকলে সবাই এ আইনের সমালোচনা করে বা কালো আইন বলে; কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সেটি আর বাতিল করে না। বরং এর মেয়াদ বাড়ায়। যদিও ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের ঘোষণার পরদিন বিএনপি যে ইশতেহার দিয়েছে, সেখানে ১৯৭৪ সালের এই বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তারা এ আইন বাতিল করবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আবার ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার ঘোষণার পরে আলাদা করে বিএনপির ইশতেহার ঘোষণার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের সঙ্গে বিএনপির ইশতেহারের মোটাদাগে কোনো ফারাক নেই। 

যেমন ক্ষমতায় গেলে বিরোধী পক্ষের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ না করা, অর্থাৎ প্রতিশোধ না নেওয়া, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, একদলীয় শাসনের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো ইস্যুগুলোতে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির অবস্থান অভিন্ন। যদিও বিএনপির ইশতেহারে গণভোট পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। অতীতে গণভোটের নামে দেশে কী হয়েছে, তা দেশবাসী জানে। কারণ সরকারের অধীনে হওয়া সব গণভোটের ফলাফলই সরকারের পক্ষে গেছে। ওই ভোটগুলো যে একটিও নিরপেক্ষ হয়নি, তা নিয়ে তর্ক না করলেও চলে। ফলে এতদিন পরে বিএনপি কেন আবার গণভোট পুনঃপ্রবর্তন করতে চায়, তা পরিষ্কার নয়। 

ঐক্যফ্রন্টের মতো বিএনপিও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা তুলে দেওয়ার কথা বলেছে। তবে বাড়তি হিসেবে তারা চাকরিতে তদবির ও বিভিন্ন সরকারি কাজে চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরেকটি বিষয় তারা খুব সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম কোর্টে ন্যস্ত করা হবে। মতভিন্নতা থাকলেও কারো কণ্ঠরোধ করা হবে না এবং অনলাইন মনিটরিং তুলে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিশিয়াল সিক্রেসি আইন বাতিলেরও যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে, সেগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন সেই পুরোনো যে এগুলো কি শুধুই কথার ফুলঝুরি নাকি বাস্তবায়ন করা হবে? আবার এসব বাস্তবায়ন করতে গেলে ক্ষমতায় যেতে হবে। এ মুহূর্তে নির্বাচনের যে পরিবেশ, তাতে বিএনপি কি মনে করে যে তারা ক্ষমতায় যাবে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ হেরে যাবে?

যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে বিএনপি সরাসরি কিছু না বললেও তারা বরাবরই এই বিচার নিয়ে এক ধরনের সংশয় প্রকাশ করে আসছিল যে এখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচার হচ্ছে। ফলে রাজনীতির মাঠে তাদের প্রধান শক্তি জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি ও অন্যান্য দণ্ড কার্যকরের পরও যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার যে ঘোষণা ঐক্যফ্রন্ট দিয়েছে, সেটি কতটা কথার কথা বা জনতুষ্টির জন্য রাজনৈতিক বুলি, তা তারা ক্ষমতায় না গেলে বোঝা যাবে না। এর একটি বড় কারণ, নানা বিতর্কেরও পরও তারা কোনোভাবেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারছে না (একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের অন্তত ২২ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে) এবং নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের জয় হলে সরকার ও ক্ষমতার রাজনীতিতে জামায়াত যে নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে, তা নিয়ে সন্দেহ না করাই ভালো। সুতরাং জামায়াতের বলয়ে থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখা বিএনপি ও তার জোটের জন্য কতটা সহজ হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখাকে ‘একধরনের তামাশা’ বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেছেন, ‘২৩ জনের অধিক যুদ্ধাপরাধীর উত্তরসূরি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছে। আর যুদ্ধাপরাধীরা ঐক্যফ্রন্টের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই আছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা করবে—এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার, অবিশ্বাস্য।’

প্রশ্ন হলো, তাহলে কি দলগুলো ইশতেহার দেবে না? নিশ্চয়ই দেবে। কারণ ইশতেহার দেখে মানুষ ভোট দিক বা না দিক, এর একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে এ কারণে যে, রাজনীতির ইতিহাস লেখা ও পর্যালোচনার জন্য ইশতেহার পাঠ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা নির্বাচনী ইশতেহারে একটি দলের রাষ্ট্র পরিচালনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, নিজ দলের আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা এবং জনগণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে শেষমেশ তারা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে বা পারে না, সেটি অন্য তর্ক। এবং না পারলে তখন সেই ইশতেহারের পয়েন্টগুলো ধরেই তাদের জবাবদিহির মুখোমুখি করা যায়।

নির্বাচনী ইশতেহারে একটা ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন বামপন্থী রাজনীতিক ও কবি আরশাদ সিদ্দিকী। লিখেছেন,

‘আংটি বদলের প্রতিশ্রুতি তো

নির্বাচনী ইশতেহারের মতো

শেষবার আমার ঘরে তুমি

বেঢপ নোলক পরে হাতের উপর

নিঃশব্দ হাত রেখেছিলে

তারপর কার সাথে আংটি বদলে নিলে

আমার হাতের উপর মৃদু চাপ ছাড়া

আর কোনো প্রতিশ্রুতি দাও নাই

আজও সকল অনস্তিত্বে

তোমার অস্তিত্ব টের পাই

চারপাশে দেখি ধাতব আংটি বদলে

ছাপানো অক্ষরের ইশতেহারেই

সকলে প্রতিশ্রুতির অভিশাপ খোঁজে।’

সুতরাং নির্বাচনী ইশতেহার ‘প্রতিশ্রুতির অভিশাপ’ না হয়ে সত্যিকারের কর্মপরিকল্পনা এবং জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর ম্যান্ডেট হিসেবে বিবেচিত হোক—এই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক