শুধু চমক নয়, শঙ্কা ও সংকটের চ্যালেঞ্জও রয়েছে

Looks like you've blocked notifications!

আগামী ৩০ জানুয়ারি একাদশ সংসদের অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে। এই সংসদের বেশ কিছু চমক লক্ষ করতে পারছি। বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপি ছাড়াই আবারও দ্বিতীয়বারের মতো একটি সংসদের যাত্রা শুরু হচ্ছে। নব্বই-পরবর্তী সংসদীয় সরকারের যাত্রায় বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংসদের বাইরে ছিল। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনকে অস্বীকার করতে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নিয়ে সংসদের বাইরে থাকছে।

এ সংসদের থাকছে ভিন্ন মাত্রার একটি বিরোধী দল। ভিন্ন মাত্রা বলছি এ কারণে যে, বিরোধী দলে যারা থাকছেন তারা বর্তমান সরকারি দলের সাথে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি যেসব স্থানে একক প্রার্থী দিয়েছিল তাদের কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। নানা ধরনের চমকের মধ্যে বিশেষ চমক হলো নতুন মন্ত্রিসভা। ইতিমধ্যেই নতুন মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করেছে। কাজ শুরু করেই তাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার অতিমাত্রায় লক্ষ করা যাচ্ছে। মন্ত্রীদের বক্তব্যে এবং চলাফেরাতে দেখা যাচ্ছে বাহারি চমক।

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই সকল সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর মোবাইল ফোন নম্বর প্রচারিত হয়েছে। নম্বারগুলোর ক্ষেত্রে বড় চমক হচ্ছে যে, চাইলেই তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটি নিশ্চই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে। আশা করছি, জরুরি আলাপে তাদের সহজেই পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যেই আমি গণমাধ্যমে পাওয়া মোবাইল নম্বরে দুজন মন্ত্রীকে ফোন করে একজনকে পেয়েছি। অন্যজন ফোন ধরেননি। তবে এটা আশার বাণী যে, যিনি ফোন ধরেছেন এবং আমার সঙ্গে পূর্ব পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও যতটুকু মনোযোগ দিয়ে কথা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী যথার্থ ব্যক্তিকেই মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন। আমি ধরে নিতে চাই, মন্ত্রিসভার সব সদস্যই আমি যার সঙ্গে কথা বলেছি তাঁর মতো সদালাপি এবং নিরহংকার হবেন। আমার মনে হয়েছে, এ ধরনের মন্ত্রীদের দ্বারাই দেশে কার্যকর অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পাশাপাশি আমি বিশ্বাস করতে চাই, এবারের মন্ত্রিসভায় যারা স্থান পেয়েছেন তাঁরা সবাই একজন সাধারণ নাগরিকের মতামত শুনতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন। মন্ত্রিসভার সদস্য কিংবা সংসদ সদস্যগণ যেন অকাশের চাঁদ না হন।

যারা মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন, তারা অবশ্যই যারা দুর্নীতি কিংবা বিগত সময়ে অপশাসনের কারণে এবার মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি তাদের কথা মনে করে কাজ করবেন। কারণ যেসব কারণে মন্ত্রিসভায় রদবদল হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গত ৫-১০ বছরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কার্যক্রমের সাথে বিতর্ক জুড়ে যাওয়া। কাজেই নিজের কাজে সততা, দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা না থাকলে পরবর্তীতে দল ক্ষমতায় এলেও মন্ত্রিসভায় জায়গা নাও হতে পারে যদি নিজের নামে বিতর্ক জুড়ে যায়। ফলে নিজের কাজের দক্ষতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রমাণ করেই নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হবে।

যারা মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে আরো বলতে চাই, পূর্ববর্তী মন্ত্রীদের যারা স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তারা যেন আগের মন্ত্রীর কোনো কল্যাণ কাজের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে বাতিল না করেন। বরং সেটিকে আরো যথাযথ রূপ দিতে ভূমিকা রাখলে সরকার পরিচালনায় সহজীকরণ সম্ভব হবে।

কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই যে সমস্যাটি লক্ষ করা যায়, সেটি হলো  নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচন-পরবর্তী তাদের আচরণ এবং ভূমিকা কয়েক ধাপে পরিবর্তন করেন। প্রথম দিকে নাগরিকদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে চান, পরের দিকে তাদের অনেকেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন, আবার শেষের দিকে তাদের পাওয়া সহজ হয়। নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে যে ধরনের আচরণ এবং প্রতিশ্রিুতি দিয়ে থাকে জনগণের সামনে,  ঠিক সে ধরনের আচরণ এবং প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  ঘটে থাকে।

সরকারের সকল পর্যায়ের অংশীজনের দায়-দায়িত্ব, বিশেষ করে মন্ত্রীদের সাফল্য-ব্যর্থতার দায় শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর গিয়েই বর্তায়। তাকেই সব দিক সামাল নিতে হয়। অন্য কোনো মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যকে হাজার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও দেশবাসীর কাছে মোটেও ক্ষমা চাইতে দেখা যায় না।

আওয়ামী লীগের বড় বিজয় হয়েছে। কাজেই মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় মত্ত হয়ে যান। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়নের জন্য সামষ্টিক উন্নয়নের চেষ্টায় থাকলে সেটি যথার্থ সুশাসন বয়ে আনবে। উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টা যেভাবে জড়িয়ে গেছে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্কের সুযোগে ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে লুটপাটের যে ধারা চালু হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। আসতে হবেই। নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নিজেদের অতিক্রম করা, ছাড়িয়ে যাওয়া। পরিবর্তন এবং সেটা অবশ্যই ভালোর দিকে।

একজন সংসদ সদস্য তাঁর দেওয়া নির্বাচনী প্রতশ্রিুতি কিংবা ইশতেহার বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে পারলেই সরকারের সফলতা সম্ভব। শধু চাটুকারদের সুযোগ না দিয়ে কিংবা তাদের কথায় কান না দিয়ে সাধারণ জনগণের প্রত্যেককেই সমান দৃষ্টিতে দেখতে পারলে সুশাসনের পথ কার্যকর হবে।

লেখক :  সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।