দৃষ্টিপাত

এ কেমন পরিচ্ছন্নতা অভিযান?

Looks like you've blocked notifications!

একটি ভিডিও অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দুজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী একটি ময়লার গাড়িতে করে পরিষ্কার রাস্তায় ফেলে যাচ্ছেন ময়লা। খানিক পর সেই ময়লা সাফ করে শুরু হবে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। শুরু করবেন সদ্য নির্বাচিত নগরপিতা। কী পরিহাস! কী উপহাস বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঢাকা শহরের অধিবাসীদের সঙ্গে। যে শহরের বাতাসে শ্বাস নেওয়া দায়, ধুলা-বর্জ্য যার পরতে পরতে, অলিগলিতে যার ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে যার রাস্তায় রাস্তায়, নাক চেপে ধরে কোনোরকমে রাস্তা পারাপার হন পথচারী মানুষের সারি, সেই নগরের নগরপিতা পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করলেন রাস্তায় কাগজের টুকরো-ময়লা ফেলে, সেই ময়লা অপসারণের মাধ্যমে। তামাশা আর কাকে বলে।

নগরবাসীর সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা অভিযানের নামে চরমতম এই মকারিটি মঞ্চস্থ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সদ্য নির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম। এমন একটি বিশেষ দিনে এই কাজটি তিনি করলেন, যেদিন এই জাতির স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ছিল। গত ১৭ মার্চ জাতির জনকের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আয়োজন করেছিল ‘বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও দেয়ালচিত্র’ কর্মসূচি। সেখানেই রচিত হলো এই লজ্জার নাটক।

প্রশ্ন হলো, নগরের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিটি কেন এই নাটক করলেন? পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করার জন্য তিনি কোনো নোংরা রাস্তা পেলেন না? নাকি আর কোনো রাস্তায় নোংরা নেই? যদি থেকে থাকে, তাহলে সাফ জায়গা ময়লা করে কেন এই লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতার ভান? জাতির জনকের জন্মদিনের বিশেষ আয়োজনে এমন একটি ভাঁওতাবাজির অভিযান তিনি পরিচালনা করতে পারলেন?

যদি এতই ইচ্ছে ছিল, তবে অপরিচ্ছন্ন বা ময়লা-আবর্জনা আছে (যদিও ঢাকার অধিকাংশ রাস্তাই ময়লা-আবর্জনা, ধুলোবালিতে ভরপুর) এমন একটি রাস্তায় অন্তত একবারের জন্য হলেও এই পরিচ্ছন্নতা অভিযানটি শুরু করতে পারতেন। যদি প্রকৃতই সদিচ্ছা থেকে থাকে, ঝাড়ু হাতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার ময়লায় একবার ঝাড়ু চালালে কারো জাত চলে যাওয়ার কথা নয়। বরং নগর ও নাগরিকদের ভালোবেসে তাদের পাশে এসে পরিচ্ছন্নতায় অংশ নিলে জাত আরো ওপরে ওঠার সম্ভাবনাই ছিল শতভাগ। মানুষ ভণিতা পছন্দ করেন না। মানুষ চায় প্রকৃতই কেউ এসে তাদের পাশে দাঁড়াক। তা ঝাড়ু হাতেই হোক বা খন্তি কোদাল হাতেই।

যে নগরীতে নগরপিতা রাস্তায় ময়লা ফেলে তা অপসারণ করেন, সেই নগরীর নাগরিকরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ময়লা-আবর্জনা, ধুলোবালি, ধোঁয়া-বর্জ্য, কাদা-দুর্গন্ধ, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে বাস করেন। দেখার যেন কেউ নেই। সকলেই নাক চেপে রাস্তা পারাপারে অভ্যস্ত। মেয়র আসে, মেয়র যায়, ঢাকার অবস্থার উন্নতি আর হয় না। তারই ভেতর এমন একটি হাস্যকর আচার চরমভাবে মর্মাহত করে বৈকি।

এমনিতেই নগর হিসেবে ঢাকা বিপর্যস্ত। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকাকে দ্বিতীয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৮ সালের মার্চে। ইউএস এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) জরিপে ঢাকার বাতাসকে বলা হয়েছে ‘ভেরি আনহেলদি’ বা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এই সূচকে ঢাকার স্কোর ২৩৮। ঢাকার ওপরে রয়েছে নেপালের কাঠমান্ডু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবমতে, বিশ্বের দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। প্রথম অবস্থান ভারতের নয়াদিল্লির। তার মানে হলো, দূষিত নগরীর তালিকা যে ভিত্তিতেই করা হোক না কেন, যারাই করুক না কেন, ঢাকার নাম সেখানে কমন। শুধু কমনই নয়, অবস্থান একেবারে তালিকার প্রথম দিকে। সেই নগরীর পরিচ্ছন্নতা সংরক্ষণ কল্পে মেয়র মহোদয়ের এমন লোক দেখানো অভিযান নগরবাসীর সঙ্গে চূড়ান্ত মশকরারই শামিল।

এমনিতেই এ দেশে জনপ্রতিনিধিদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের আস্থার সংকট চরমে। নানাবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে এই সংকটের ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হয়েই চলেছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আস্থার জায়গা তৈরি করতে নানাভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন বছরের পর বছর। অধিকাংশ জনগণই তাদের ওপর নির্ভর করতে অনভ্যস্ত। তারা নিজেদের নাগরিক চাওয়া-পাওয়া, সুখ-সুবিধার দায়ভার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বিরস মুখে মেনে নিয়েছেন নাগরিক টানাপড়েনের জীবন। তাঁরা জানেন, একটু ‍বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জমবে হাঁটুপানি, সেই পানি পাড়ি দিয়েই যেতে হবে অফিসে। রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ যেন থাকবেই, ধুলোবালি যেন উড়বেই। এই যেন শহরের আসল রূপ। বছরের পর বছর একই দৃশ্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে চোখ। ময়লার ভাগাড় সামনে পড়লে নাকে হাত চেপে রাস্তা পার হওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তা সম্ভবত নাগরিকদের মাথায় আসেই না আজকাল আর। তাঁরা স্বপ্নেও হয়তো ভাবেন না, পরিচ্ছন্ন একটি শহর পাওয়া তাঁদের অধিকার। এ জন্যই তাঁরা বছর বছর বহন করেন ট্যাক্সের বোঝা।

একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার আর্থিক খরচ নাগরিকরা মেটালেও তাদের ভাগ্যে জোটে লবডঙ্কা! নাগরিক সুবিধা বলতে যা বোঝায়, তা আটকা পড়ে যেন বড়বড় ফাঁকা বুলি আর উন্নয়ন প্রকল্পের ফাঁদে! দৃশ্যত ফলভোগ আর হয় না। বছরভর রাস্তায় চলতে থাকে খোঁড়াখুঁড়ি। এ খোঁড়াখুঁড়ি আর শেষ হয় না। রাস্তা মেরামতের ছয় কি নয় মাসের মধ্যেই আবারও শুরু হয়ে যায়। বাসাবাড়িতে মশার যন্ত্রণায় টেকা যায় দায়। অথচ মশক নিধনে বাজেট থাকে কোটি কোটি টাকা। অর্থ নিধন ঠিকই হয়, মশক নিধন হতে দেখা যায় না। বরং ঢাকার মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বংশবিস্তার করে চলেছে ঢাকার মশা বাহিনী। ভাগ্য ভালো হলে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের কিছু কিছু এলাকায় হঠাৎ হঠাৎ মশক নিধন ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়। যদিও নগরীর অধিকাংশ এলাকার লোকজনই এদের দেখা শেষ কবে পেয়েছেন জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবেন না।

ময়লা-আবর্জনা, অপরিচ্ছন্নতা, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, মশা ইত্যাদিসহ ঢাকা শহরে নানাবিধ সমস্যার অন্ত নেই। সম্মানিত মেয়র মহোদয় যদি প্রকৃত অর্থেই নগরবাসীকে একটি পরিচ্ছন্ন নগর উপহার দিতে চান, তবে লোক দেখানো এসব কর্মসূচি বাদ দিয়ে তাঁকে আসলেই পরিশ্রম করতে হবে। তিনি একদিন রাস্তায় ঝাড়ু হাতে নামলেন কি নামলেন না, তাতে নগরবাসীর কিচ্ছু যায় আসে না। তার দায়িত্ব হলো একটি বসবাসযোগ্য নগর নিশ্চিত করা। এ জন্য তার নিজের হাতে ময়লা সাফ করার দরকার নেই। এ জন্য রয়েছে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাঁদের কাজে লাগাতে হবে। জনবল সংকট থাকলে সেই সংকট দূর করতে হবে। বাজেট ঘাটতি থাকলে সেটাও মেটাতে হবে। মোটের ওপর নুন-তেল যাই লাগুক, সেটার ব্যবস্থা মেয়র মহোদয়কেই করতে হবে। লোক দেখানো, মিডিয়া কভারেজের এই সকল সস্তা জনপ্রিয়তার অযথা কার্যক্রম না চালিয়ে যথাযথ পরিকল্পনামাফিক নগরীর স্বাস্থ্য উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হবে।

প্রয়োজনে স্থানে স্থানে নাগরিক সভা করে, গণ্যমান্য নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঢাকা নিশ্চিতকরণ কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করতে হবে। প্রকৃতই যদি তিনি নগর ও নাগরিকদের প্রতি আন্তরিক হন, তখন আর লোক দেখানো ফটোবাজির এইসব কর্মসূচির প্রয়োজন পড়বে না। মানুষ এমনি তাকে মাথায় তুলে রাখবে।

লেখক : শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী।