অভিমত

নুসরাত আমরা কি বেঁচে আছি?

Looks like you've blocked notifications!

এইখানে এই পোড়াভূমে এখন আর জীবনবাদিতার চর্চা হয় না। নানা অপঘাতে মানুষ মরবে এটাই যেন এই জনবসতির অমোঘ নিয়তি। আর মানুষটি যদি হয় নারী তবে তার মরণ হবে বড় করুণ। তার পোশাকআশাক নিয়ে আলোচনা হবে, চলনবলন নিয়ে কটূক্তি হবে, কাপুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে নিন্দায় জর্জরিত হবে। অতঃপর পুরুষতন্ত্রের সম্মিলিত জোট ওই নারীকে আগুনে দাহ করবে। সামনে জুজু হিসেবে রেখে দেবে প্রাগৈতিহাসিক ধর্মের অন্ধকার বাতাবরণ। আমরা আর সামনে এগুনোর পথ পাচ্ছি না। নরকেও কি আমাদের জায়গা হওয়া উচিত? মানুষের বোধ, বুদ্ধি ও বিবেকে কতটা পঁচন ধরলে শিশু ও নারী ধর্ষণকে মহামারির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়? প্রার্থনালয় কিংবা ধর্মশিক্ষালয়ে পর্যন্ত ছেলে শিশুকে শিক্ষকরা বলাৎকার করে খুন করে ফেলতে পারছে? মানবিকতার কতটা অধঃপতন হলে নারী নিপীড়কের পক্ষে মিছিল সমাবেশ করা যায়?

শুভকাজে বাঙালির আর মন বসে না। বিস্ময়কর হলেও সত্য অধিকাংশ বাঙালি এখন চূড়ান্তরূপে নেতিবাচকতার আইকন হয়ে ওঠতে চাইছে। পুরুষের জুলুমবাজি নীরবে সয়ে যাওয়ার মন্ত্রও শেখানো হচ্ছে নিগৃহীত অবহেলিত নারীকে।

আজকের বাংলাদেশের এমন বাস্তবতায় সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফি অনন্য অসাধারণ। পিতৃতুল্য শিক্ষক ওর নারীত্বকে অসম্মান করেছে। সম্ভ্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এসব ক্ষেত্রে ওস্তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবার স্পর্ধা কোনো শিক্ষার্থীর থাকে না। কিন্তু নুসরাত আর সবার মতো অভব্যতা সয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে ছিল না। পাষণ্ডের দেওয়া আগুনে ৮০ ভাগ পোড়া শরীরের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়েও গভীর স্পর্ধা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে যেতে পেরেছে, ‘আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত…আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, সারা পৃথিবীর কাছে বলব এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য’ শিক্ষাগুরুর চরম অসভ্যতাকে নানামুখী চাপে পড়ে যেই বন্ধুরা সমর্থন দিয়ে গেছে তাদের দুঃসাহস নিয়ে আবেগঘণ চিঠি লিখতে পেরেছে, 'আমি লড়ব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আমি প্রথমে যে ভুলটা করেছি আত্মহত্যা করতে গিয়ে। সেই ভুলটা দ্বিতীয়বার করব না। মরে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া। আমি মরব না, আমি বাঁচব। আমি তাকে শাস্তি দেব। যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নিবে। আমি তাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেব। ইনশা আল্লাহ।’

প্রভূত স্বার্থ চিন্তায় আমরা এখন মিনমিনে স্বভাবের হয়ে গেছি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা ঝামেলা মনে করে অন্যের বিপদকে পাশ কাটানোকেই কর্তব্য জ্ঞান করে চলেছি। নিজের জীবন বিপন্ন হলেও হয়ত আমরা আর মুখে ‘রা’ করতে পারব না। এমন একটা অবস্থার মধ্যে নুসরাত হয়ে উঠল প্রতিবাদের দৃপ্ত আইকন। নুসরাতের এভাবে অকাল মৃত্যু কাকে নাড়া দেয়নি? নুসরাতের এমন অনন্য বিদ্রোহকে কে সম্মান জানায়নি?

হতে পারত নুসরাতের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সকলের সমস্বর প্রতিবাদ। শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর রাস্তায় নেমে প্রতিকার চাইতে পারত দেশের মৌলভীরা। কিন্তু তারাও আজ স্বার্থচিন্তা ছাড়া কথা বলেন না, কাজও করেন না। তা না করুন এবার অন্তত মৌলভীরা স্বীকার করুন নারীর ধর্ষিত বা খুন হওয়ার জন্য তার পোশাক বা চলন দায়ী নয়। অষ্টাদশী নুসরাত হিজাব পরা মাদ্রাসা ছাত্রীই ছিল। আর নিপীড়ক একজন শিক্ষক নামধারী মাদ্রাসা অধ্যক্ষ। কাজেই নারী নিপীড়নের একমাত্র দায় হলো পুরুষের উদ্ধত বেপরোয়া দৃষ্টি আর দুর্বীনিত লালসা। এবার অন্তত আপনারা বলুন, নারী গণিমতের মাল নয়, নারীকে অবগুণ্ঠিত হয়ে বসে থাকবার সময় এখন নয়, নারী শুধু পতিসেবা আর সন্তান উৎপাদক নয়। কেবল চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নয় পুরুষের সমান শিক্ষা পাওয়া নারীরও জন্মগত অধিকার। গার্মেন্টসে নারী কর্মী মানেই ব্যভিচারি নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন ১৩ দফার জঞ্জাল মগজ থেকে ঝেড়ে ফেলে এবার অন্তত সাম্যবাদী মানবতার কথা বলুন। ধর্ষক বা খুনির কোনো আস্তিক-নাস্তিক নেই। মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে না থেকে বোধসম্পন্ন আধুনিক মানুষ হিসেবে সকল অনৈতিকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। সুন্দর ও সত্যের কথা বলুন। 

আমরা কোনোকালে কলপনাও করতে পারিনি যে, একজন নারী নিপীড়ক ধর্ষক ও খুনির পক্ষে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, পৌর কাউন্সিলর, মেয়র কিংবা থানার ওসি পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তাদের নিজেদের কন্যা সন্তান নেই। পিতা হিসেবে, ভাই, সন্তান বা স্বামী হিসেবে ভগ্নি কন্যা জায়া জননীকে কীভাবে মুখ দেখাতে পারে তারা? এই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ভার কেমনে সইতে পারছে নুসরাতের বিপর্যস্ত পরিবার? পৃথিবীতে কি এখন তাহলে বর্বর যুগ চলছে। অপরাধীর অভয়ারণ্য কি আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ? সময় এসেছে, মানুষকে সত্যিকারের সভ্যতার ছবক দেওয়ার। আর্থিক সক্ষমতা অর্জন মানেই সাফল্য বা উন্নয়ন নয়। মানবিক মানুষ না থাকলে উন্নয়নের পূজা করবার কেউ থাকবে না। দেশের আইনের ধারক ও বাহক আমাদেরই ভাই-বোন বন্ধু বা স্বজনরা। আইনের শাসনকে কীভাবে রোজকার চর্চার বিষয় করা যায় তা জনে জনে আমাদের সবাইকেই ভাবতে হবে। শিক্ষায়তনের সেকেলে বিবিধায়ন রহিত করে বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতিবান যুক্তিপ্রবণ এবং নিজের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিত ও বিশ্বস্ত মানুষ গড়ায় মনোনিবেশ করতে হবে এই রাষ্ট্রকে। কেবলমাত্র নামাজ আদায়, রোজা রাখা, কোরআন-হাদিস পড়া, নারীর পর্দা মেনে চলা, দাঁড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে চলা জীবন নয়, সমাজে দুর্নীতি, মানবীয় বিচিত্র অপরাধ প্রবণতা আর পেশাগত জীবনে অসদুপায় অবলম্বনের বাজে তরিকা থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখবার প্রচেষ্টা হোক ধর্মীয় বিধান অনুসরণের আসল স্বরূপ। চতুর্দিকে বর্বরতার নজির তিরোহিত হোক।       

নুসরাত সসম্মানেই আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে। অভিশাপের সবটা নারী নিপীড়ক আর তাদের দোসরদের জন্যই লেখা থাক। আমরাই আসলে মরে বেঁচে আছি। আমাদের এই সম্মিলিত মৃত্যুকে পরাভূত করে জেগে ওঠবার মন্ত্র হোক ‘অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করবই -ইনশাআল্লাহ’ নুসরাতীয় এমন দৃপ্ত অঙ্গীকার। হাল ছেড়ে দেয়া আমাদের স্থবির জীবনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বচন চিরসত্য হয়ে ভাস্বর থাকুক:

আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু

আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু

দুর্দিনের এই দুর্গশিরে

উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।

অলক্ষণের তিলক রেখা

রাতের ভালে হোক-না লেখা-

জাগিয়ে দেরে চমক মেরে

আছে যারা অর্ধচেতন।  

 

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন