মে দিবস

গাহি মানুষের জয়গান

Looks like you've blocked notifications!
রোদে পুড়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করেন শ্রমজীবী মানুষ। ছবিটি ঢাকার আমিনবাজার থেকে তোলা। ছবি : স্টার মেইল

রোদবৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে কাজ করেন চাষি ভাই, আমাদের পেটে অন্ন জোটে। কলকারখানা চালান আজন্মের নিষ্পেষিত শ্রমিক, আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ে। এই যে মাঠের চাষি, মুটে মজুর, কারখানার শ্রমিক—যারা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে চলেন, খাদ্য জোগান সেইসব শোষিত জনের জন্য সবল সমাজপতিরা কী রাখেন? মে দিবসের সাম্যবাদী গান, আলোচনা সভা আর একদিনের বাহবা, এই তো। বলবানের সারা বছর। আর শ্রমিকের মোটে এই এক দিন। অন্ধকারের সাথে জন্ম জন্মান্তরের বাঁধন শুধুই শ্রমিকের একার। আর আলোকের ঝর্ণাধারার নিঁখুত ব্যাপারী ঈশ্বরসখা বড়লোকেরাই। অন্তর্যামী মুখ ঘুরিয়ে রাখুক, সক্ষমের তাচ্ছিল্য থাকুক, তবু খুশিই থাকে আমাদের কর্মনিষ্ঠ শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা। আজ আমরা সাম্যের গান গাইব। বাঁধা-ব্যবধান এক হয়ে যাওয়ার কথা বলব। এটুকু আশাবাদী খুশিরা সুস্থির থাকুক আর মে দিবস চিরজীবী হোক।     

কালো শ্রমিকের রক্ত ও ঘাম শোষে সারা বিশ্বের সাদা পুঁজিপতি বা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের অবস্থান তৈরি করবার যুগযুগান্তরের যে অপপ্রয়াস, অধিকার আন্দোলনের সোয়া শ বছর পরে এসেও সে অবস্থার তেমন বদল ঘটেনি। তবু কালের নিয়মে এক বছর পরপর মে দিবস আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। আমরা ঘটা করে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিয়ে সরব হই। মে দিবসের চেতনা নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে গালগপ্প করি। তারপর মে দিবসের সূর্যাস্ত ঘটে, যেখানকার শ্রমিক সেখানেই থাকে বহাল তবিয়তে।

আমরা কেউ কি দেখেছি, মে দিবস এলেই বাস-লেগুনার শিশু হেলপারের কাজ বন্ধ থেকেছে। কারো জানা আছে, পোশাক কারখানার অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের কাজের চাপ কমিয়ে তার ন্যায্য মজুরি মালিক সাহেবরা বুঝিয়ে দিয়েছে। ট্যানারির বর্জ্য দুর্গন্ধে যে মানুষটি কাজ করে আপনার জুতো ও ব্যাগের জোগান ঠিক রাখে, তাকে একদিনের জন্য ফুলের বাগানে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে? কোনো এক ঘুপচি ঘরের গরমে পাখাবিহীন ছোট্ট শিশুর লেদ মেশিন চালানো বন্ধ থাকবার কথা কেউ শুনেছে। কেউ কি দেখেছে, যে ধর্ম শিক্ষালয়ের খুদে শিশুটি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তার ধুলোয় বসে দু-এক টাকা চাঁদা তোলে, সেই শিশুটি টাকা কম নিয়ে গেলে ওস্তাদজি তাকে মাফ করেছে? শ্বেত শুভ্র বড়লোকের কালো কাজের মেয়েটি মে দিবস বলেই কি বিশ্রাম আর দু মুঠো ভাত বেশি পেয়েছে। আজ কি তপ্ত দুপুরে রিকশাওয়ালা ভাই সহৃদয়বান আপনার কাছ থেকে পাঁচ টাকা বেশি পাবে? রাস্তায় ঘুরে দিনরাত খেটেখুটে জনপদের সুখ-দুঃখের খবর আপনার কাছে পৌঁছাতে কাজ করে যায় যে সংবাদ শ্রমিক, শতবর্ষেও কি তার ভিখিরিদশা কাটবে? না এর কোনো কিছুই ঘটে না। ঘটেওনি কোনোদিন!

তবু অধিকারের কথা বলে সরব গলায় মে দিবসের গীত বাজানো হয় সর্বত্র। যে নেতাটি আজ সফেদ পাঞ্জাবি আর বিদেশি লোবানের ঘ্রাণ মিশ্রিত সুশোভন সুখের শরীর নিয়ে মঞ্চে হাজির হয়ে পান খাওয়া মুখে ন্যায্য অধিকারের ভাষণ দিবেন, তার মাইকের মাউথ পিচটি উঁচু-নিচু করে দেবেন সেই কলরেডির জীর্ণ পোশাকের শিশু শ্রমিকটিই। নেতার ড্রাইভারের আজ একদণ্ড ফুরসৎ মিলবে না নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস ফেলবার। একাধিক মিটিং মিছিলে তাড়াতাড়ি নেতাকে পৌঁছে দেওয়াই আজ তার কাজ।

অথচ ১৮৮৬ সালের ০১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের দাবিতে হাজারো শ্রমিকের সমাবেশে পুলিশের গুলিতে শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সাড়ম্বরে মে দিবস পালিত হচ্ছে আজ। শ্রমিকের সংহতি, মানুষের বিজয় আর নতুন শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে নাকি আনন্দ উৎসবে দিনটি পালিত হচ্ছে! কিন্তু এই মে দিবসের আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে আসলে ভাগ্য বিড়ম্বিত শ্রমিকের জীবনে কী এলো গেল তার খবর রাখে কোন জনা?

গণসংগীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কথা, বলো সাথী সবদিনই আমাদের পয়লা মে/ দুনিয়ার মজদুর এক হও এই ডাক শুনি যেদিন/ সেদিনই মে দিন সাথী সেদিনই মে দিন!–এই কথাগুলোই প্রতিটি শ্রমিকের জীবনে অমর অক্ষয় হয়ে থাকবার কথা। কিন্তু তা আর থাকে কি? যেখানে মে দিবসই সত্য ও সুন্দররূপে মে দিবস নয়, সেখানে অন্যদিনের আবার মে দিন কি?

সভ্যতার রথ চলে শ্রমিকের বাহুবলে। পৃথিবীর চাকা চলে শ্রমিকের রক্ত ঘামে। পুঁজিপতি সভ্যতার ইতিহাসকাররা না মানুক ১৮৭০ সালের দিকে আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার মেরি ম্যাক ডেলিনের স্বামী কালো শ্রমিক জন হেনরির কথা লেখা থাকে শ্রম ইতিহাসের সোনালি পাতায়। পাথুরে পাহাড়ে রেল রুট তৈরি করতে সাদা মালিকের স্টিম ড্রিল মেশিনের সাথে নিজের হাতুড়ি দিয়ে শ্রম প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে যিনি শ্রমিকের অধিকার আন্দোলনের সারবত্তা প্রমাণ করে যান। সেই জন হেনরির কথকতার করুণকাব্য উচ্চারিত থাকে শ্রমিক, সাধারণ বা দাসদের মুখে, মনন ও মস্তিষ্কে। শ্রমিকের একাগ্রতা আর কাজের ধ্যানের কাছে হার মানা সেই সাদা মালিকদের এখনকার বংশধররাও একই হারের ঘূর্ণাবর্তেই খাবি খেয়ে যাচ্ছে। এখনো শিশু শ্রমিককে মজুরিবিহীন আর নারীকে স্বল্প মজুরিতে কাজ করিয়ে নেওয়ার লোভী মানসিকতার ভূত তার শক্তপোক্ত ভিত গেড়ে আছে মালিকদের বিলাসী উঠোনেই। এমন অবস্থা পরিবর্তনের সুবর্ণরেখা হয়তো পরাভূতই থাকবে। সভ্যতার কারিগররা মালিকের ভাবগম্ভীর অন্দরমহলে অচ্ছুৎই থাকবে। তবে তা কি অনন্তকাল?

আত্মশ্লাঘায় ভোগা মালিক নামের স্বঘোষিত দেবতার রাজ্যে মেহনতি মানুষ গণদেবতাদের নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম। সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাঠি-ঝাঁটা খেয়ে মরে।

ধনিক শ্রেণির হাতে কথায় কথায় মার খাওয়া সেই শ্রমশিল্পীদের নিয়ে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তার ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় যথার্থ বলেছেন-

‘তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি

তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাইল ধূলি

তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান

তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান

আজ নিখিলের বেদনা আর্ত পীড়িতের মাখি খুন

লালে লাল হয়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ।

সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি

এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশি।’

আজও রানাপ্লাজা কিংবা তাজরীন ফ্যাশনের মালিকদের বিচার সম্পন্ন করা গেল না। দুঃখী-পোড়া মানুষের হাহাকারের দিনও ফুরল না। তাহলে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেওয়া সেই কালিধূলিমাখা সেবক শ্রমিকের সত্যিকারের মুক্তি আসবে কোন আলোয় কবে কখন? তা জানে কেবল কর্মের ঈশ্বর। হাজারো নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম মোকাবিলা করে এগিয়ে যাক শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির সংগ্রাম। অধিকারের পূর্ণতায় প্রতিটি দিন হোক তার মহামুক্তির মে দিবস। জয় হোক মেহনতি মানুষের। আমরা সেই মানুষের জয়গানই গাইব।

আজ মহান মে দিবসে গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সুরে শ্রমের বন্দনাই হোক আমাদের শেষ কথা :

প্রতি মে দিবসের গানে গানে

নীল আকাশের তলে দূর

শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ

হেনরীর হাতুড়ির সুর

হো হো হো হো- হেনরীর হাতুড়ির সুর।

হো হো হো হো-হেনরীর হাতুড়ির সুর

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন