সর্বজনীন উৎসব

বাঙালির দুর্গাপূজা

Looks like you've blocked notifications!

বাঙালি জাতি অদ্ভুতই বটে। অনেকটা নাচুনে বুড়ির মতো, ঢোলের বাড়ি খালি পড়ার অপেক্ষা। ব্যস, বাঙালি কোনো ছুতোনাতা ধরে উৎসবে মেতে উঠবেই। তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। জাতিধর্মের কোনো ভেদাভেদ মানে না বাঙালি। হবে নাই বা কেন, যে বাঙালির ঋতুর মধ্যেই এত রং, তারা কি পারে ঘরের কোণে মুখ গোমড়া করে পড়ে থাকতে? আর সে কারণেই হয়তো এমন পোড়া দেশের মানুষগুলো পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক না কেন, যত ভালো আরাম আয়েসেই থাকুক না কেন, এই হতভাগা দেশের কোনো গানের কলি কিংবা বেগুনপোড়া ভর্তার কথা মনে পড়লেই কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসাবে।

মানুষের দোষ দিয়ে লাভ নেই, এই দেশটাই এমন, এর প্রকৃতিই এমন পাগলপারা। উৎসব যেন মুখিয়েই থাকে এই বাংলার ঘরে ঘরে। ছয়টি ঋতুর অপূর্ব ঐকতান আমাদের মনের আকাশেও কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি আবার কখনো বা বেদনার ধূসর চাদরে ছেয়ে যায় প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। তাই শরতের ঝকঝকে নীল আকাশ আর শুভ্র কাশবন যখন বাঙালির মনে দারুণ রোমান্টিকতার দোলা দিয়ে যায় সেই মুহূর্তেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাও তাতে বাড়তি আনন্দের আবির মেশায়।

প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গেই মানুষের যাপিত জীবনের নানা নির্দেশনাও থাকে। প্রতিটি ধর্মীয় আচারের মধ্যেই মানুষের জন্য বিশেষ একটি বার্তা থাকে যা জীবনাচরণের অনুষঙ্গ। শারদীয় দুর্গাপূজারও আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ভক্তদের জন্য একটি বিশেষ ‘ম্যাসেজ’ থাকে আর তা হলো ভূমি হচ্ছে মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ আর তাতে যে শস্যাদি ফলে তা মানুষের জীবনধারণের জন্য খুবই জরুরি। প্রকৃতির শক্তিই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। প্রকৃতি দেয় শস্য। সনাতন ধর্মের আদিগ্রন্থ বেদে বলা হয়, ভূমিই হলো মাতা। ভূমিতেই জন্মে মানুষের জীবনধারিণী উদ্ভিদ। প্রকৃতি যেন ঠিক মায়ের মতোই আগলে রাখে মানুষকে। প্রকৃতির সব সম্পদ রক্ষায় মানুষকে সচেতন করানো হয়ে থাকে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে। তাই মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পৃথিবী কিংবা ভূমির দেখভালো করবে। ধর্মীয় আচারের এই বিশ্লেষণ ছাড়াও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। হিন্দুধর্ম ও এর অনুসারীদের হাজার হাজার বছরের বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী কোন বাহনে চড়ে মর্ত্যলোকে আসবেন ও ফিরে যাবেন তার ওপরই নির্ভর করছে বাঙালির জীবনাচরণ ও প্রকৃতি। ধর্মের মধ্য দিয়ে এক এক এলাকার সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে যেমন মা দুর্গা তাঁর সন্তানসন্তুতি নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন যখন প্রতিটি গেরস্থের বাড়ি শস্যে শস্যে ভরে ওঠে। দুর্গাপূজার মধ্য দিয়ে গেরস্থালির সুন্দর ভবিষ্যতের আরাধনা করা হয়ে থাকে।

দেবালয় থেকে দেবী দুর্গার আগমনের মূলমন্ত্র হচ্ছে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টির পালন। অসুর বিনাশ করে তার ভক্তদের কল্যাণ সাধন। দেবী দুর্গাকে সবাই মা দুর্গা, পার্বতী, মহামায়া, কৈলাসী, দুর্গতিনাশিনী, চণ্ডী, বাসন্তী, পরমা প্রকৃতি, নারায়ণী, ভদ্রকালী, হৈমবতী, ঈশ্বরী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী ইত্যাদি নানা নামে ডাকে। কোনো কোনো মতে বলা হয়, দুর্গা কোনো দেবীর নাম নয়। যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন বলে তাঁকে দুর্গা নামে পূজা করা হয়ে থাকে।

‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, ‘উ’-কার বিঘ্ন বিনাশ করে, রেফ রোগ বিনাশ করে, গ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং ‘অ’-কার শত্রু বিনাশ করে। এর অর্থ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। অর্থাৎ সত্য-সুন্দরের আরাধনা করবে মানুষ যা মানুষকে পাপাচার থেকে দূরে রাখবে। সেই পাপাচার মানে কি শুধুই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা? না তা কিন্তু নয়। প্রতিটি ধর্মেই আমরা দেখি, ষড়রিপুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার নামই ধর্ম। অন্য ধর্মের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ হিংস্রতা দেখানোর কথা কোনো ধর্মেই নেই অথচ মানুষ উৎসব পালন করে কিন্তু উৎসবের যে মূল উদ্দেশ্য তাই অনেকেই মনে রাখে না। আমি এখানে ‘অনেকে’ শব্দটি ব্যবহার করেছি ইচ্ছা করেই, কারণ গুটিকয়েক মানুষের জন্য দেশশুদ্ধ মানুষকে কিংবা আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে কিছু ধর্মান্ধ মানুষের জন্য পুরো জাতিকে দোষারোপ করা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।

শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ক্রিকেটার লিটন দাশ ফেসবুকে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন কিন্তু একজন মানুষ(!) তার প্রত্যুত্তরে যে নোংরা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ালেন তা কোনোভাবেই দেশের সব মুসলমানদের মনোভাব ধরে নিতে পারি না। এটা একান্তই সেই ব্যক্তিটিরই বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙচুর করছেন সেটা গুটিকয়েক অসুস্থ মানুষের কর্মকাণ্ড হিসেবেই ধরব আমরা। কারণ যুগ যুগ ধরে এই দেশে এখন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে উদযাপন করে। প্রায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে কাজ করে, সর্বজনীন পূজা হয়ে ওঠার এটাই তো মাহাত্ম্য। দেশের এমন একটি পূজামণ্ডপ নেই যেখানে মুসলমানরা সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। এই দেশেই এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মসজিদ-মন্দির পাশাপাশি, সেখানে পুরোহিত কিংবা ইমাম সাহেবদের কোনো সমস্যা হয় না আর সমস্যা হয় না অনুসারীদেরও। এই দেশে ধর্মের নামে হিংস্রতা ছড়ানোর অপচেষ্টা বারবার হয়ে এসেছে, এখনো হচ্ছে কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হয় না। পারস্পরিক ভালোবাসার মেলবন্ধনে এসব নীচুতা ধুয়েমুছে যায়। তার প্রমাণ এবার দেশে পূজামণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে আনুষ্ঠানিকতার জৌলুস। পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি কাজল দেবনাথও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় শঙ্কা প্রকাশ করলেও পূজা উদযাপন শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আশ্বস্ত করেছেন এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই তাদের। গুটিকয়েক ধর্মান্ধ কিছু মানুষের নৃশংসতার কাছে পরাজিত হতে পারে না এই দেশের বিশাল অংশের মানুষের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ।

এবারের দুর্গা প্রতিমার গড়নে নানা বৈচিত্র্য তুলে ধরার তুমুল প্রতিযোগিতা হয়েছে দেশব্যাপী। এখন কিন্তু প্রতিমা গড়ার কাজে হিন্দুদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষদেরও দেখতে পাই, খুব সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষের বিষবাষ্প তাদের আত্মাকে নষ্ট করে দেয়নি। ঈদ-পূজায় একে অপরের বাড়িতে খুব সহজ সুন্দর যাতায়াত। আমরা আশা করতেই পারি যাঁরা ধর্মের নামে ভেদাভেদ ছড়াচ্ছেন, তাঁদের নির্মূল করা অসম্ভব হবে না।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে ধর্ম নিয়ে হানাহানির ভিড়েও একটা বিষয়ে সবাই যেন একসূত্রে গাথা। আর তা হলো নারীকে যতই দেবীরূপে পূজা করা হোক না কেন, নারী বরাবরই নির্যাতনের শিকার। আর তাঁর সেই রূপ আমরা দেখি চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকার পাঁচবাড়ি পূজামণ্ডপে যেখানে নারী নির্যাতনের নানা রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিদেশি হত্যাসহ নানা আতঙ্কের মধ্যেও এবারের শারদীয়া দুর্গাপূজা অনেক ভালোভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা আশা করতেই পারি সব মলিনতাকে দূরে সরিয়ে দেশের সব ধর্মের মানুষ ভালোবাসার মেলবন্ধনে একে অপরকে বেঁধে রাখবে।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এনটিএন নিউজ।