পুলিশ বাহিনীর ভিজিবিলিটি

Looks like you've blocked notifications!

অনেক সময় কোনো ঘটনা ছোট বলে অবহেলা করার পর দেখা যায়, ওই সামান্য ঘটনা থেকেই বড় ঘটনার জন্ম নেয়। ফেনীর সোনাগাজী থানা সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বেলায় পুলিশ বিভাগ কি অনেকটা সেই রকম অবহেলা করেছে? নাকি এই বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছে করেই মোয়াজ্জেমের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে এক লুকোচুরি করে তাকে লাপাত্তা হতে সহায়তা করেছে? ফেনী ও রংপুর দুই জায়গার পুলিশই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ মে পরোয়ানা জারি করে। ৩১ মে পরোয়ানার চিঠি ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছায়। কিন্তু পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান বারবার বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে রাতে পরোয়ানা হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। এর দুদিন পর বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে পরোয়ানা রংপুর রেঞ্জে পাঠানো হয়। এখন আবার রংপুর রেঞ্জ বলছে, কাজটি বিধি মোতাবেক হয়নি।

এই হলো পুলিশ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমকে নিয়ে খবর। কিন্তু মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক এস এম রুহুল আমিনের (ডিআইজি) নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিটির রিপোর্ট সবার প্রশংসা কুঁড়িয়েছে, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন - পিবিআইয়ের কাজও প্রশংসিত হয়েছে। প্রশ্ন হলো ওসি মোয়াজ্জেমের বেলায় কেন বাহিনীর সুনাম লঙ্ঘিত হলো?

আর্থিক দুর্নীতি আমরা অনেক কথা বলি এবং সেই দুর্নীতি দৃশ্যমানও। কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহার করে, নিয়ম ও রীতি বাঁকিয়ে বা লঙ্ঘন করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার যে দুর্নীতি, তা আর্থিক দুর্নীতির চেয়েও বড় অপরাধ। ফেনীর সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন সে কাজটি করেছেন। তিনি হত্যার ইন্ধন দাতা মূল আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার পক্ষ নিয়ে এই মেয়েটিকে এবং তার পরিবারকে হয়রানি করেছেন, থানায় ডেকে নুসরাতের কথা ভিডিওতে ধারণ করে ডিজিটাল প্লাটফর্মে ছেড়ে দিয়েছেন। তাকে রক্ষা করার বড় চেষ্টা করেছেন ফেনী জেলার সেই সময়ের আলোচিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম (এসপি), তাকেও অপসারণ করা হয়েছে এস এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে। এসপি আর ওসির আচরণ ছিল পুলিশী স্বেচ্ছাচারিতার দৃষ্টান্ত। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর আর পিবিআইয়ের কাজ ছিল বাহিনীর পেশাদারত্ব আর দক্ষতার দৃষ্টান্ত।   

নুসরাতের ঘটনায় দেশব্যাপী নাগরিক মধ্যবিত্ত প্রতিবাদ করেছে। মানববন্ধন আর  স্মারকলিপি দেওয়া ছাড়া বেশি কিছু করার ঝুঁকি ছিল। কিন্তু নুসরাতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে তার অবস্থান থেকে মেয়েটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন, অপরাধীকে শাস্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে প্রশাসন আর স্থানীয় রাজনীতির পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

নাগরিক জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষায়, জঙ্গি খতমে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে, পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন হয়েছে গত ১০ বছরে আন্য অনেক সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে জননিরাপত্তায় পুলিশ বাহিনীর বড় দায়িত্ব আছে এবং সেই দায়িত্বে চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রায় ১৭ কোটির বেশি মানুষের দেশে জননিরাপত্তার বিষয়টি খুব সহজ নয়। একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই এই বাহিনীকে কাজ করতে হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জঙ্গিবাদী হামলাহুমকির মোকাবিলায় পুলিশ বাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সবাই স্বীকার করে।

চুরি-ছিনতাইসহ সাধারণ অপরাধের পাশাপাশি ইদানীং বেড়েছে সামাজিক অপরাধ- সহিংসতা। এমনই এক ঘটনা ধর্ষণচেষ্টার প্রতিবাদ করায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা। এসব রোধে করণীয় নির্ধারণ দরকার। কারণ দুই একজন মোয়াজ্জেম যে এমনসব অপরাধে সম্পৃক্ত হবে না সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া উদ্দেশ্যমূলক গ্রেপ্তার, নির্যাতন, খুনের মতো বড় বড় অপরাধকর্মেও এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমনসব ঘটনায় পুলিশের পেশাদারত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে, সততা নিয়ে সন্দেহ জাগে।

পুলিশ সমালোচনার মধ্যে পড়ে, কারণ তার কাজ দেখা যায় বেশি। প্রশাসনের অন্যান্য শাখার তুলনায় পুলিশী তৎপরতা অনেক বেশি দৃশ্যমান। তাই পেশাদারত্ব আর সক্ষমতা সবসময় সামাজিক নজরদারিতে থাকে। তাই তাদের সচেতন হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন।

তবে আমরা জানি পুলিশের কাজের ক্ষেত্রে পদে পদে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং স্বাধীনতার অভাবও থাকে। যার জেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি যে স্বাভাবিক সম্ভ্রম থাকার কথা, সেটা নষ্ট হয়। মানুষ মনেই করে যে পুলিশের পক্ষে স্বাভাবিক কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। জনবহুল দেশে পুলিশের নিরপেক্ষ কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি। স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের আচরণ এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পুলিশের চাকরিটা খুব আরামদায়ক নয়। সময় অসময়ে দায়িত্ব পালন, দীর্ঘ সময় ধরে ডিউটি করা—সবই আছে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় পুলিশ বাহিনীতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাও খুব সহজ নয়। প্রতিকূল পরিবেশ, মান্ধাতার আমলের আইন এবং নৈরাজ্যের মধ্যেও কিছুসংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। পুলিশের মধ্যে এমন কর্মকর্তার সংখ্যা কম হলেও আছে। যেসব সৎ পুলিশ অফিসার সব বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে নাগরিক সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করেন, তাদের শ্রদ্ধা না করার সংস্কৃতি থেকেও আমাদের বের হতে হবে। সমাজে এমন পুলিশবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যেখানে পুলিশের ভালো কাজ প্রশংসিত হয় না।

ফেনী জেলার সাবেক এসপি ও ওসি যেমন আছেন, তেমনি আমরা দেখলাম পিবিআইয়ের মতো দক্ষ বিভাগ আছে, ডিআইজি এস এম রুহুল আমিনের মতো নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাও আছেন। এই দৃষ্টান্তগুলো বলে দেয়, পুলিশের যোগাযোগ কাঠামোকে আরো পেশাদার করা হোক, যেন তার পেশাদারত্ব আর সক্ষমতার ‘ভিজিবিলিটি’ দৃশ্যমান হয়। 

লেখক : এডিটর ইন চিফ, জিটিভি ও সারাবাংলা