যেকোনো ছুতায় ডাক্তার ধোলাইয়ের প্লাবন

Looks like you've blocked notifications!

রোগীর মৃত্যুকে মেনে নিতে না পেরে স্বজনদের হাতে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত এক চিকিৎসককে মারধরের দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। স্বজনরা বলছেন, সেই ডাক্তার সর্বক্ষণ রোগীর পাশে ছিল না, অন্যদিকে ডাক্তারের ভাষ্য হলো—রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে দ্রুত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিলেও স্বজনরা বিলম্ব করায় বরগুনা হাসপাতালেই ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়।

কলকাতায়ও আমরা সম্প্রতি এমন এক ঘটনা দেখেছি অনলাইনে। নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীর মৃত্যু এবং চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে দুই জুনিয়র ডাক্তারকে মারধর করা হয়। এর পরই বিক্ষুব্ধ ডাক্তাররা সারা পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘট শুরু করলে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ে। পরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ধর্মঘট থেকে সরে আসেন চিকিৎসকরা।

ছুতা পেলেই ডাক্তার ধোলাইয়ের প্লাবন আমরা দেখছি অনেক দিন ধরে। রোগী মারা গেলেই হাসপাতাল, ক্লিনিক ভাংচুর, তছনছ। কোনো চিকিৎসা ভুল কি না তা নির্ণয় করবে কে? সেই উত্তরে না গিয়ে একটা কথা জানা দরকার, ভুল নির্মাণকাজের জন্য কি প্রকৌশলী বা ঠিকাদারকে মারা হয়? জনসম্পদ লুটের জন্য কি আমলারা বা জনপ্রতিনিধিরা মার খান? সন্ত্রাসীরা মানুষের জীবনকে তছনছ করে দেয়, তাদের কি মারা যায়? কত ভুল মামলায় কত মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়, দায়ী যারা তাদের মারা হয়?

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর সংবাদ প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে যখন এমন ভাংচুর হয়। কিন্তু সেটা কতটা ভুল আর কতটা রোগীর স্বজনদের অতিরিক্ত প্রত্যাশা তা বুঝতে পারা কঠিন। ভুল চিকিৎসা যে হয় না তা নিশ্চয়ই স্বয়ং চিকিৎসকরাও অস্বীকার করবেন না। তার চেয়েও যেটা বেশি তাহলো ভুয়া চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেটি নিয়ে যতটা না খবর, তার চেয়ে বেশি খবর চিকিৎসকের ভুল ধরা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে চিকিৎসকের ভুল ধরবে কে? রোগীর আত্মীয়রা আবেগের বশে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করেন। সাংবাদিকরাও বিশেষজ্ঞ নন। গণমাধ্যম বড়জোর ভুল চিকিৎসার অভিযোগ বলে খবর দিতে পারে, ঘটনা তুলে ধরতে পারে। একজন ডাক্তারের ভুল ধরতে পারে আরেকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ভুল বোঝাবুঝি সেখানেই, কারণ কখনোই কোনো পক্ষ থেকে পরীক্ষিত কোনো জবাব আসে না। রোগী এবং ডাক্তার উভয়ই যার যার প্রেক্ষাপট থেকে কথা বলেন।

ডাক্তারদের ব্যাপারে আমার নিজেরও মিশ্র ধারণা আছে। কিন্তু বরগুনার ডাক্তারকে মারা যে দৃশ্য দেখেছি তা মানা যায় না। সামান্য নিরাপত্তা ও শ্রদ্ধা না পেলে বড় শহরের বাইরে চিকিৎসকরা কেন যাবেন? আবার কেউ মারা গেলেই ভুল চিকিৎসা হয়েছে বলে ভাংচুর করার যে সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে তা ভয়ংকর। কে নির্ধারণ করছে যে চিকিৎসা ভুল হয়েছে? আর যদি হয় তার প্রতিকার কি হাসপাতাল ভাংচুর বা তছনছ বা চিকিৎসকের ওপর হামলা?

হাসপাতালে রোগী মারা যাবে, এটা স্বাভাবিক। আবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে, সেটাও স্বাভাবিক। একটা কথা জানতে চাই, রোগী মারা গেলে আমরা উত্তেজিত হই, কিন্তু সুস্থ হলে কজন ডাক্তার ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ দিই? সত্যিই যদি রোগী মৃত্যুর কারণ ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলায় হয়ে থাকে, তাহলে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। বিএমডিসির আইনে আছে, কোনো চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা করেছে এমন যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই চিকিৎসকের নিবন্ধন পর্যন্ত বাতিল করতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। হামলা, ভাংচুর, চিকিৎসককে মারধরের কারণে শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী হন সাধারণ জনগণই।

সমস্যা এখানেও আছে। বিএমডিসি যদি তার কাজটা ঠিকমতো করত, তাহলে ডাক্তারদের ব্যাপারে অন্যরকম একটা ধারণা তৈরি হতো। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের নৈতিক চরিত্র নিয়ে সমাজে ব্যাপক শোরগোল আছে। অনেক সিনিয়র চিকিৎসকই স্বীকার করেন, জোর গলাতেই বলেন, চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যে মূল্যবোধের লজ্জাকর অবক্ষয় ও অতি হীন কিছু কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার নজির আছে।

একটি অন্যতম অভিযোগ হলো রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও হাসপাতাল-নার্সিংহোমে রোগী পাঠিয়ে তার বিনিময়ে টাকা বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়াকে চিকিৎসকদের একাংশ অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। এটা অনৈতিক, ক্ষতিকারক। সাধারণ মানুষের ক্ষতি তো বটেই, এতে করে চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাও কমে যায়। এ অবস্থা আকাশ থেকে পড়েনি, চিকিৎসার বাজারের ক্রমপ্রসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তার সাংস্কৃতিক ও চরিত্রগত চাহিদা মেটাতে গিয়েই এটা ঘটছে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে এখানে।

পণ্য হিসেবে চিকিৎসার চরিত্র পাঁচটা ভোগ্যপণ্যের মতো হতে পারে কি না, সে প্রশ্নও আছে। চিকিৎসা কেনাবেচার মধ্যে থাকে একটা মানুষের শরীর, মন, জীবনমরণ। উৎকোচ, দালালি ইত্যাদি বিষয় এই পেশার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। চিকিৎসকরা অনেকেই নিশ্চয়ই এখনো সেটা জানেন, মানেন। সমাজে, যেকোনো ক্ষেত্রে, এমন মানুষেরা আছেন বলেই সমাজ প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে চলে। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশের কাছে এগুলো আর অন্যায় নয়, বরং প্রায় অধিকারে পরিণত। এবং এই অংশটা ক্রমশ বাড়ছে। কেবল সংখ্যায় নয়, দাপটেও। আগে তবু একটু গোপনে চলত, এখন সব একেবারে প্রকাশ্যে এসে গেছে। আগে যা ছিল কানাকানি, এখন তা কলরব।

আবার যেসব চিকিৎসক নিজেদের বিকিয়ে দেননি, নিজের প্রতি, নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল রয়েছেন তারাও চুপচাপ থাকেন। ফলে দুর্জনের গলার জোর বাড়ে, দুষ্কর্মের পরিধিও প্রসারিত হয়। আর সব পেশার মতো এখানেও যারা দুর্বৃত্ত, তারা সাহস পেয়ে ক্রমশ এসে পড়েন বড় রাস্তায়। লোভ আর লাভের পিঠে চড়ে চিকিৎসাসেবার মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ান। এদের স্বভাব ও চিন্তার অন্ধকার তখন অন্য সব আলোকে গ্রাস করতে থাকে, লোভের বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমাজে। এরাই চোখ রাঙিয়ে বলতে শুরু করেন, তারা যে পথে চলছেন সেটাই সাফল্যের পথ।

এই পথের আকর্ষণ স্বভাবতই বিপুল। অর্থ, স্বাচ্ছন্দ্য, সুযোগ, প্রতিপত্তি, এসবের এক আশ্চর্য মাদকতা থাকে। পেশাগত পরিসরে এই ধরনের মাদকপ্রবাহ যখন তীব্রতা পায়, তখন তা ন্যায়-অন্যায়ের বেড়াজাল ভেঙে দেয়। চিকিৎসা পেশায় যুক্ত কিছু মানুষ এই অন্যায়কে ন্যায্য ব্যবসা বলছেন, সেটা বড় কথা নয়, সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, তারা সেটাকেই সমস্ত পেশার স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, প্রভাবিত করতে চাইছেন বৃহত্তর পরিমণ্ডলকে।

এসব প্রশ্ন তুলতে গেলেও আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা জরুরি। সমাজের সর্বত্র যখন ঘা, তখন নিশ্চয়ই ভাবতে পারিনা যে চিকিৎসকরা দূর দ্বীপে বাস করেন। তবে ডাক্তারদের দায়িত্ব আছে। চিকিৎসার পেশায় যুক্ত সৎ, বিবেকবান মানুষরা নিজেরাই যখন নিজেদের ভেতরকার অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন, অসৎ চিকিৎসকদের অন্যায় সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করবেন, চিকিৎসা নামক ব্যবসার অন্ধকার দিকগুলো সম্বন্ধে মানুষকে জানাবেন, তখনই পরিবর্তন আসবে। অনেক চিকিৎসক আছেন, যারা পেশাকে বিকিয়ে দিয়েছেন ওষুধ কোম্পানি, হাসপাতাল আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনের কাছে। কিন্তু এটাই সব নয়। মেডিকেল কাউন্সিল আর চিকিৎসক সংগঠনগুলো যদি এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তাহলে চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে নিশ্চয়ই।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।