গ্রামের নাম ঢাকা
পাশের কলকাতায় হাতে টানা রিকশা, আমাদের ঢাকাসহ সারা দেশে প্যাডেলের রিকশা। কলকাতায় হাতে টানা রিকশার সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্যাডেলের রিকশার সাথে ইঞ্জিন লাগানো আধা যান্ত্রিক রিকশার সংখ্যা মানুষের বংশ বৃদ্ধির মতো কেবল বেড়েই চলেছে।
রাজধানীর সড়কগুলোয় শৃঙ্খলা ফেরাতে আজ ৭ জুলাই থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন কুড়িল থেকে মালিবাগ (প্রগতি সরণি) এবং গাবতলী থেকে আসাদগেইট (মিরপুর রোডের একাংশ) পর্যন্ত প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ডিএনসিসির আওতাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভা শেষে এ ঘোষণা দেন।
রিকশাই কেবল শহরের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে তা নয়, কিন্তু রিকশার মতো অত্যন্ত ধীর গতির একটি অযান্ত্রিক বাহন শত শত যান্ত্রিক বাহনের নগরীতে বড় সমস্যা তৈরি করছে সমস্যা যে করছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ঢাকায় কেন এত যানজট, কেন এত সমস্যা তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে এবং হতেও থাকবে। কিন্তু ঢাকাই পৃথিবীর একমাত্র বর্ধিষ্ণু রাজধানী যে শহরে একই রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহন আর ধীর গতির যানবাহন চলাচল করে, তাও আবার একসঙ্গে৷ একই সড়কে বাস-মিনিবাস, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান, এমনকি ঘোড়ার গাড়িও চলে৷ ঢাকায় এখনো নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা সাত লাখ৷ কিন্তু বাস্তবে ২০ লাখ প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচল করে এই শহরে৷ ফলে যানবাহন আর গতি পায় না।
ইচ্ছা থাকলে যেমন উপায় হয়, সদিচ্ছা থাকলে তেমনই অনাচার রুখতে পারা যায়, অন্তত নিয়ন্ত্রণ করা তো যায়ই। উত্তরের মেয়র সেই সদিচ্ছা দেখাবার চেষ্টা করছেন। কলকাতায় প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা বন্ধ হয়েছে সেই কবে। আমাদের চেয়ে কম আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে একটি প্রাদেশিক শহর যদি পারে, আমাদের না পারার কোনো কারণ নেই। অনেকেই তথাকথিত দারিদ্র্যের কথা বলছেন, বলছেন বিকল্প কর্মসংস্থান না করে রিকশা যেন তুলে ফেলা না হয়।
প্রথমত রিকশা কিছু প্রধান সড়কে বন্ধ হয়েছে, সংযোগ সড়কে ঠিকই আছে। তারপরও যারা রিকশাওয়ালাদের দরিদ্র বলছেন, তারা আসলে তাদের করুণা করছেন। এ রকম একটা অমানবিক কাজের প্রতি তারা প্রকারান্তরে সামন্ততান্ত্রিক প্রণোদনা দিচ্ছেন। নিজে লাট সাহেবের মতো সিটে বসে থাকবেন মালপত্র নিয়ে, আর তাকে রোদে ঘেমে বৃষ্টিতে ভিজে শারীরিক শক্তিতে টেনে নিয়ে যাবেন আরেকটা মানুষ।
আর বিকল্প কর্মসংস্থান করে রিকশা তুলে ফেলার প্রস্তাবটা ঠিক বোধগম্য নয়। তারা নিজেরা কোনো সুনির্দিষ্ট বিকল্পের কথা বলতে পারছেন না। সত্যিকার অর্থে বিকল্প ভেবে কোনো কাজ হয় না। যখন রিকশা চালু হয়েছিল তখন কোনো না কোনো বাহনকে সে প্রতিস্থাপন করেই এসেছিল। তাই রিকশার প্রতিস্থাপনও মানুষই সৃষ্টি করবে। যাদের গাড়ি নেই তাদের কী হবে, এই ভাবনা ভেবে কোনো দিনই আর সমাধানের পথে চলা যাবে না। স্বল্প দূরত্বেও সস্তায় আরামে যাওয়া যায় বলে এ শহরের মানুষের হাঁটার অভ্যাস গড়ে উঠেনি। এ কথা সত্য যে, সব সড়কে হাঁটার পরিবেশ নেই। আমরা সেই দাবি তুলতেই পারি এবং নগর কর্তৃপক্ষ তথা সরকারকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ কথাও সত্য যে, আমাদের আমলা নির্ভর নগর পরিকল্পনায় প্রাইভেট কার ভিত্তিক ভাবনা বেশি, গণপরিবহন সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। আমাদের গণমানুষের জন্য গণপরিবহনই ভরসা এবং প্রাইভেট কার কেন্দ্রিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে সেদিকে যেতে হবে। কিন্তু তাই বলে রিকশা চলতে দিতেই হবে, সেই ভাবনাও যৌক্তিক না।
আমাদের এই শহরে দরকারের তুলানয় রাস্তা কম। একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন৷ কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র সাত থেকে আটভাগ৷ এর মানে হলো, প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে৷ ঢাকা শহরের মোট এলাকা এক হাজার ৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক৷ অত্যন্ত বেদনার বিষয় এই যে, অন্যদিকে ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে৷ এ ছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই হেঁটে চলেন নগরবাসী৷ ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট৷
ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ৷ বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করে৷ এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা৷ বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করে৷ ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি৷ তার মানে, জনসংখ্যার হিসাবে শতকরা এক ভাগেরও কম মানুষের প্রাইভেট কার রয়েছে৷ কিন্তু সড়ক চলে গেছে প্রাইভেট কারের দখলে৷
ঢাকায় যানজট নিরসনে স্বল্পমেয়াদে, কম খরচে কিছু পরিকল্পনা করা দরকার। এর একটি হলো প্রধান সড়কে রিকশা বন্ধ করা, ফুটপাথকে দখলমুক্ত করা আর অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা। এ টুকু করা গেলেই যানজট উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসবে৷ মেগা প্রকল্প নিয়ে যত ভাবনা, এই ছোট ভাবনাগুলো এর চেয়ে বেশি উপকার দিত। এই শহরটিকে গ্রাম করে রেখেছে রিকশা আর ফুটপাত দখল। বিকল্প ব্যবস্থা না করে রিকশা তোলা যাবে না, হকার উচ্ছেদ করা যাবে না বলে যারা চিৎকার করে তারা আসলে দিশাহীন। মনে রাখা দরকার রিকশা কোনো উৎপাদনশীল পরিশ্রম নয়, আর ফুটপাতের একমাত্র মালিক পথচারী।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা