আমার সন্তান যেন থাকে (দুধে) ভাতে

Looks like you've blocked notifications!

পুষ্টিকর খাবার বলতে মায়েরা বোঝেন দুধ আর ডিম। যুগে যুগে অনেক  কিছু পাল্টেছে। কিন্তু দুধ-ডিমের এই ধারণা পাল্টায়নি। আমাদের ছেলেবেলায় ডিম কিনে খাওয়ার চল ছিল না। বাসায় হাস-মুরগি পালতাম।  সেই হাস বা মুরগির ডিমেই মিটত পুষ্টির চাহিদা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাস ও মুরগির খোয়াড় খুলে দিতাম। হাস-মুরগি বেড়িয়ে যাওয়ার পর খোয়াড় থেকে খুঁজে নিতাম ডিম। তবে দুধ খেতে হতো কিনে।

ছয় ভাই বোনের সংসারে সবার ভাগ্যে নিয়মিত দুধ-ডিম মিলত না।  তবে উৎসবে-পার্বণে বা কারো অসুখ-বিসুখ হলে তবেই দুধ-ডিমের সন্ধান হতো। বাড়িতে গরু পালেন, এমন কোনো প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে দুধ কেনা হতো।  কেনা মানে আমরা গিয়ে জগ নিয়ে গাভীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মালিক আমাদের সামনেই দুধ দোয়াতেন। গাভীর বানে অল্প সরিষার তেল মাখিয়ে দুধ দোয়ানো ছন্দটা এখনো কানে বাজে। আস্তে আস্তে ভর্তি হতো দুধের বালতি। দুধ দোয়ানোর সময় ফেনায়িত শুভ্রতা আমাকে মুগ্ধ করত। তবে মাঝেমধ্যে দুধ কিনতে বাজারে যেতাম। সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা সমান সমান। জগে করে এক সের বা দুই সের দুধ  নিয়ে আসতেন বিক্রেতারা। কেনা হতো এক পোয়া বা আধাসের।

ঈদ বা বড় কোনো উৎসব হলেই বেশি দুধ কেনা হতো। এখন দুধ বেচা-কেনার ধরনটা পাল্টে গেছে। কিন্তু  দুধে যে পুষ্টি, সে ধারণাও বিন্দুমাত্র বদল আসেনি। আমার ছেলে প্রসূনকে ছেলেবেলা থেকেই দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। সে খুব আনন্দের সাথে খায়, তা নয়, প্রায়ই ফাঁকি মারে। সুযোগ পেলে আমাদের চোখের আড়ালে গ্লাসের দুধ বেসিনে ফেলে দেয়। ছেলেবেলায় আমরা দুধ খেতে পেতাম না। আর আমার ছেলে দুধ খেতে চায় না। দুধ শুধু শিশুদের জন্য নয়, সব বয়সী মানুষের জন্যই উপকারী। ব্যাকপেইন থেকে বাঁচতে ডাক্তার আমাকেও নিয়মিত দুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ দুধ হাড়ের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।

গাভির পাশে দাঁড়িয়ে দোয়ানো দুধ এখন আর পাওয়া যায় না। বাজার থেকে কিনে আনা হতো পাস্তুরিত দুধ। মাস খানেক ধরে প্রসূনের আনন্দের সীমা নেই। বিশুদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পর থেকেই দুধ কেনা বন্ধ। তবে এখন থেকে তো চাইলেও কেনা যাবে না। হাইকোর্ট পাঁচ সপ্তাহের জন্য পাস্তরিত দুধের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন। তবে হাইকোর্ট মনের আনন্দে দুধ উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেননি। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল), আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি), বাংলাদেশ  বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল (বিসিএসআইআর) ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ  গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) ফুড সেফিটি ল্যাবরেটরিতে আলাদাভাবে  পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ও সিসার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল হাইকোর্ট বিএসটিআই অনুমোদিত ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন।

জনস্বার্থে একটি রিটের ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট এ আদেশ দিয়েছেন। পাস্তুরিত দুধ নিয়ে হাইকোর্টে শুনানির সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেন। সে রিপোর্টেও পাস্তুরিত দুধে  এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছিল। সে রিপোর্ট দিয়ে যেন বিপাকে পড়েন অধ্যাপক ফারুক। প্রথম রিপোর্ট প্রকাশের পর সরকারি-বেসরকারি নানা মহল থেকে অধ্যাপক ফারুককে হুমকি দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে দেশি দুগ্ধ শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। অধ্যাপক ফারুকের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে বিদেশি এজেন্ট বলা হয়। কিন্তু কোনো হুমকিতেই দমে যাননি অধ্যাপক ফারুক। দ্বিতীয় দফা পরীক্ষায়ও পাস্তুরিত দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এরই মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরীক্ষায়ও পাস্তুরিত দুধে ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে। আর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পর পাস্তুরিত দুধের ঝুঁকিটি প্রমাণিত হলো। এটা ঠিক অধ্যাপক ফারুকের রিপোর্ট, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মামলা আর সবশেষে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা দেশি দুগ্ধ শিল্পে বিপর্যয় ডেকে আনবে।

দুধের প্রয়োজনীয়তা আগের মতো থাকলেও উৎপাদনের ধরনটা পাল্টে গেছে। এক লিটার-দুই লিটার করে বাজারে করে বিক্রি করার দিন আর নেই। দুধের চাহিদাও বেড়েছে, উৎপাদনও বেড়েছে। এখন বড় বড় খামারে বেড়ে ওঠে গাভি। পাবনা ও সিরাজগঞ্জেই উৎপাদিত হয় দেশের সিংহভাগ দুধ। এসব এলাকার খামারিদের কাছ থেকে বিএসটিআই অনুমোদিত ১৪টি কোম্পানি দুধ সংগ্রহ করে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে আট লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি লিটার ৪০ টাকা দরে, প্রতিদিন তিন কোটি ২০ লাখ টাকার দুধ কিনত কোম্পানিগুলো। কিন্তু হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পর ১৪টি কোম্পানিই দুধ কেনা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু সমস্যা হলো দুধ কেনা বন্ধ হলেও গাভীর দুধ দেওয়া তো আর বন্ধ হবে না। তার মানে প্রতিদিন তিন কোটি ২০ লাখ টাকার দুধ জলে যাবে। আর এই পরিস্থিতি দেশের দুগ্ধ শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবক ফেলবে। বড় কোম্পানিগুলোর ক্ষতি হবে। তবে তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে।

কিন্তু ক্ষুদ্র খামারিদের অনেকে পথে বসে যাবেন। কিন্তু দেশীয় দুগ্ধ  শিল্পের যতই ক্ষতি হোক, ক্ষুদ্র খামারিদের অবস্থা যাই হোক, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান আছে, এমন দুধ বাজারে রাখার কোনো সুযোগ নেই। কোনো মা তো জেনেশুনে তার সন্তানের মুখে বিষ তুলে দেবেন না। তবে আমার বিশ্বাস, এই সম্ভাব্য বিপর্যয়েই লুকিয়ে আছে দেশীয় দুগ্ধ শিল্পের টেকসইভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা। হাইকোর্টের এই উদ্যোগের মাধ্যমে যদি পাস্তুরিত দুধ নিরাপদ হয়, তাহলে সবারই লাভ। দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে তো দাগই  ভালো। একই সাথে বিএসটিআইকে দুধসহ সব খাবারের মান যাচাইয়ে সক্ষম করে তুলতে হবে। কারণ আমরা চাই, খাদ্যের মান যাচাইয়ে যেন একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থাকে।

পাস্তুরিত দুধে এন্টিবায়োটিক বা সিসার মতো ক্ষতিকর উপাদান আসে কোত্থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার একটা ধারণার কথা বলতে পারি। দুধ সংগ্রহ করার পর কোম্পানিগুলো পাস্তুরিত করার প্রক্রিয়ায় এন্টিবায়োটিক বা সিসা মেশায়; এটা আমার মনে হয় না। কেন তারা পয়সা খরচ করে বাড়তি দুটি উপাদান মেশাবে। আমার ধারণা, খামারেই দুধে এই উপাদানগুলো থাকে। আর সেই উপাদানগুলো গরুর খাবারেই  থাকে বলে আমার বিশ্বাস। গরু মোটাতাজা করতে, বেশি দুধ পেতে খামারিরা গরুকে  নানান কিছু খাওয়ান। অপ্রয়োজনে সাবধানতা হিসেবে নানা ধরনের এন্টিবায়োটিকও খাওয়ানো হয়। গরু এখন আর আগের শুধু মতো ঘাস, ফেন, খৈল খায় না। সাথে অনেক কৃত্রিম খাবারও খায়। আমার ধারণা সংকটটা এই গোখাদ্যেই। খাবারের উপাদানগুলো থেকে যায় দুধেও। অসুস্থ হলে গরুকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো যেতে  পারে। তবে সেটা হবে ডাক্তারের পরামর্শে, পশুর জন্য নির্ধারিত  এন্টিবায়োটিক। আর এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোর পরের ২১ দিন দুধ সংগ্রহ বন্ধ রাখলেও দুধ নিরাপদ হবে।

হাইকোর্টের দেওয়া পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে যদি পুরো দুগ্ধ শিল্প যদি নিরাপদ হয়ে যায়; তাহলে সেটা হবে একটা বড় পাওনা । মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যে মাঝি ঈশ্বরী পাটনী দেবতার কাছে বর চেয়েছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। এখন নিশ্চয়ই কোনো মা দেবতার কাছে, সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার বর চাইবেন না। তবে আমরা চাই, আমার সন্তান দুধে-ভাতেই থাকুক, তবে সেই দুধটি যেন হয় নিরাপদ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক