জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অগণতান্ত্রিক ভূমিকা

Looks like you've blocked notifications!

লিখেছেন : আনু মুহাম্মদ, নাসিম আখতার হোসাইন, মানস চৌধুরী, সাঈদ ফেরদৌস, শরমিন্দ নীলোর্মি,  মির্জা তাসলিমা, স্বাধীন সেন, রায়হান রাইন, মাহমুদুল সুমন, সায়েমা খাতুন, নাসরিন খন্দকার, হিমেল বরকত, রায়হান শরীফ, সাহিদ সুমন ও পারভীন জলী

 

সম্প্রতি সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা অপরাপর সব পর্যায়ের সক শিক্ষকের বেতনের জন্য যে গ্রেড নির্ধারণ করেছে, তাতে শিক্ষকদের আপেক্ষিক অবস্থানের অবনতি ঘটেছে, এতে আমরা ক্ষুব্ধ। এই বিষয়ে শিক্ষকদের যুক্তি, প্রতিবাদ ও আন্দোলন নিয়ে মনোযোগ বা বিচার-বিবেচনা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্তব্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি যে তাচ্ছিল্য দেখিয়েছেন এবং ধমকের সুরে কথা বলেছেন, তাতে শিক্ষার প্রতি এই সরকারের বৈরী মনোভাব আরো স্পষ্ট হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাথে একত্রিতভাবে বেতন কাঠামোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তবে আমরা মনে করি প্রথমত, এই আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় শিক্ষার প্রতি অমনোযোগিতার বিরুদ্ধে বক্তব্য ও কর্মসূচি যোগ করা উচিত। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দাবি করে আসছে। আমরা মনে করি, অন্যান্য পর্যায়ের সব শিক্ষককে অন্তর্ভুক্ত করে এই আন্দোলন পরিচালনা করা উচিত। তা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য কেবল আলাদা বেতন কাঠামো চাওয়া খণ্ডিত, তা সমস্যার মূল ধরতে পারবে না। কেননা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রায় অভুক্ত রেখে শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হবে না, ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাও তথৈবচ থাকবে। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না, গবেষণা করা শিক্ষকের জন্য অন্যতম একটি মৌলিক কাজ, অথচ গবেষণা কাজে রাষ্ট্রের যেমন কোনো বরাদ্দ নেই, আবার তেমনি শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা ও দায়-দায়িত্বের বিন্যাসব্যবস্থা গবেষণাকর্মে তাঁদের নিরুৎসাহিত  করে। ফলে সব শিক্ষকের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দাবির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষদের কর্মঘণ্টা পুনর্নির্ধারণ করে উল্লেখযোগ্য হারে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। আমরা মনে করি বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আন্দোলনে এই প্রসঙ্গগুলো অনুচ্চারিত থাকায় এই আন্দোলন দিশাহীন হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে আন্দোলনে গণতান্ত্রিক চর্চার ঘাটতি ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হলেও, আন্দোলনের দাবি ও কৌশল প্রসঙ্গে বেশির ভাগ সময়ই সব শিক্ষকের মতামতকে সংযুক্ত করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যেমন দেখা যাচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এই সময়ে সাধারণ সভা আহ্বান না করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের কার্যক্রমগুলোতে সম্মতি দিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সাধারণ সভায় গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের কৌশল প্রসঙ্গে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা ফেডারেশনের কৌশলের থেকে ভিন্ন হওয়াতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে ফেডারেশন থেকে বহিষ্কারের মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা আমরা পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পারি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এর ব্যত্যয় দেখিনি। গত ১৭ অক্টোবর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে শিক্ষকদের আসন্ন ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আবার ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত এর বিপরীতে বলে তা পুনর্বিবেচনার জন্য ১৯ তারিখ জরুরি সভা ডাকা হয়। জরুরি সভায় বিভিন্ন সদস্যের বক্তব্য শেষে সভাপতি গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে শিক্ষকদের অংশ নেওয়ার একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সভায় বক্তব্য পেশকারীরা ছাড়া উপস্থিত সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগই পান নাই। সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদ অপরাপর সদস্যদেরও আমরা এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। তদুপরি সমিতির সভাপতি বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় জাবি শিক্ষকদের ‘ম্যানেজ’ করেছেন ইত্যাদি ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন (সূত্র : কালের কন্ঠ ০০/১০/১৫)। এইসব কর্মকাণ্ড শিক্ষক হিসেবে আমাদের খাটো করছে। দেশের গণতান্ত্র চর্চায় ঘাটতি হলে শিক্ষকদের যেখানে ভূমিকা রাখবার কথা, সেখানে নিজ নিজ পেশাগত সংগঠনে এই রকম অগণতান্ত্রিক মনোভাব চর্চা ও তার ফলে গৃহীত আন্দোলনের দাবি ও কৌশল আমাদের সর্বসন্মুখে হাস্যস্পদ ও খেলো করে তুলছে। আমার এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং সবাইকে জানাতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো শিক্ষা ও শিক্ষকের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁরা কোনো দল বা পক্ষের লাভ-ক্ষতির চাইতে জনগণের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন, ফলে তারা প্রয়োজনে যেকোনো সংগ্রামের জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দাবিগুলো নিম্নরূপ : অষ্টম বেতন কাঠামোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেশাগত যে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তা দূর করতে হবে । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। জিডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে (জাতিসংঘের প্রস্তাবে জিডিপির শতকরা ৭ ভাগ) বাড়াতে হবে। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সব ক্ষেত্রে এই বরাদ্দের সুষম বণ্টন করতে হবে। অচিরেই সব পর্যায়ের শিক্ষকের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো গঠন করতে হবে।
 

লেখক : জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকগণ।