মশা নিধনে চাই সঠিক ব্যবস্থাপনা

Looks like you've blocked notifications!

জুন থেকে আগস্ট, ২০১৯, মশা নিয়ে আমরা কমবেশি সবাই আতংকে কাটিয়েছি। এখনো এই আতংক বিরাজমান। সাধারণ থেকে বিশেষ, সবার অভিজ্ঞতাই ছিল বেশ তিক্ত। এডিস মশা ও ডেঙ্গু ভাইরাসের কাছে আমরা এক প্রকার পরাজিত। বিগত প্রায় দুই দশক ধরে এডিস মশা আমাদের জন্য সমস্যা হলেও এই বছরের প্রাদুর্ভাব সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক। প্রশ্ন হলো, এই মশা বা মশাবাহিত রোগ কি শুধু আমাদের বাংলাদেশেই সমস্যা? না, তা নয়।  বিশ্বের অনেক দেশে (প্রায় ১২৫টি দেশে) এই সমস্যা আছে। গোটা পৃথিবীর ৪০%-এর বেশি মানুষ (প্রায় ২.৫ বিলিয়ন) মশাবাহিত রোগ, বিশেষ করে এডিস মশা বা ডেঙ্গু রোগের রিস্কের মধ্যে আছে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ এখন মারাত্মক ডেঙ্গুপ্রবণ। এডিস প্রজাতির মশা মূলত এই ডেঙ্গু-ভাইরাস ছড়ায়। এডিস মশা ও ডেঙ্গু রোগের মোকাবিলা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও প্রোটেকশন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সফল ও টেকসই মশা নিধন ব্যবস্থাপনা। তাই এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা খুবই জরুরি।

দেশে বর্তমানে মশার নিধন বা দমন কার্যক্রম পুরোটাই সিটি করপোরেশন নির্ভর। মশা নিধন কর্তৃপক্ষ বলতে আমরা সিটি করপোরেশনকেই বুঝে থাকি। তবে মশা দমনের বিষয়টা এই একক কর্তৃপক্ষ যেভাবে দেখছে বা সার্বিকভাবে যেভাবে দেখা হচ্ছে তাতে সফল ও টেকসই মশা নিধন খুব কঠিন হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মশার নিধন বা দমনকে সাধারণ ভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ নিয়ে নতুন করে ভাবতেই হবে। মশা নিধন খাতে আমরা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছি কিন্তু সুফল মিলছে না।  তাই, মশা নিধনের বিষয়টাকে আলাদা নজর দিয়ে দক্ষ লোকবলের সমন্বয়ে যুগোপযোগী, গবেষণা ভিত্তিক ও প্রযুক্তি নির্ভর ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করা যেতে পারে। আমাদের প্রয়োজন একটি সফল ও টেকসই মশা নিধন ব্যবস্থাপনা।

বর্তমানে আমাদের মশা নিধন কার্যক্রম প্রধানত কীটনাশক (স্প্রেইং/ফগিং) নির্ভর।  তবে আমাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতো বলা যায়। ইদানীং সোর্স রিডাকশন (লার্ভা ধ্বংসকরণ) কার্যক্রমও উল্লেখ করার মতো।  তবে মশার কার্যকর নিধনের জন্য বেশ কিছু বিষয় আগাম জানতে গবেষণা অতীব জরুরি একটি বিষয়। আমাদের মশা নিধন কার্যক্রম মোটেও গবেষণা নির্ভর নয়। এ বিষয়ে আমরা নির্ভর করি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন- আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর’বি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদির ওপর। আর যেটাকে আমরা সমন্বয় বলছি। দেশে মশা নিয়ে যতটুকু গবেষণা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে এবং তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। ফলে গবেষণালব্ধ কোনো ফলাফল আমরা বাস্তবে কাজে লাগতে পারছি না। আমরা কীটনাশক প্রয়োগ করছি কিন্তু মশা মরছে না। কেন মরছে না, তার প্রকৃত কারণ আমাদের জানা নেই। মশা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসছে। মনে রাখা প্রয়োজন, মশা নিয়ে নিয়মিত/রুটিন গবেষণা করে এর সঠিক দমন পদ্ধতি (কীটনাশক বা জৈবনাশক, কী মাত্রায়, কীভাবে, কখন ইত্যাদি) বের করতে হবে। নইলে মশার সফল নিধন কঠিন হবে। তাই মশার সফল নিধনে কয়েকটা বিষয়ে জোর দেওয়া দরকার।

১. কীটনাশক প্রয়োগে সতর্কতা

আমাদের মশা নিধন (অপারেশন) ব্যবস্থার আধুনিকায়ন দরকার। এ ক্ষেত্রে মশার বায়োলজি ও কীটনাশক সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান সম্পন্ন ও দক্ষ লোকের প্রয়োজন। অপারেশন টিমকে/টেকনেশিয়ানকে কীটনাশক প্রয়োগে যথাযথ ট্রেইনিং দিতে হবে। কীটনাশকের (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) সঠিক ব্যবহার বিধি তাদের জানতে হবে। ফগার মেশিন ছাড়াও নতুন নতুন মেশিন (ইউএলবি স্প্রেয়ার) ব্যবহার জানতে হবে। কীটনাশক বাছাইয়ে আরো সতর্ক হতে হবে। একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার পরিহার করতে হবে। প্রয়োগ তালিকায় নতুন ও কার্যকরী এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড যোগ করতে হবে। কীটনাশক যাতে কোনো ভেজাল না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কীটনাশকের ভুল প্রয়োগ/অতিপ্রয়োগ চলবে না। এতে মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। মনে রাখতে হবে, একই কীটনাশকের ব্যবহার, মাত্রারিক্ত/ভুল ডোজে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। এডিসসহ অন্যান্য মশা (কিউলেক্স, এনোফিলিস ইত্যাদি) শনাক্তকরণের পাশাপাশি, টারগেট ও নন-টারগেটস প্রজাতির রক্ষারও ব্যবস্থা নিতে হবে। 

কীটনাশক প্রয়োগের আগে বেশ কিছু বিষয় জানা অতীব জরুরি। যেমন : মশার স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রজনন কেন্দ্র  চিহ্নিতকরণ (ভেক্টর ম্যাপিং), পরিণত মশার উপস্থিতি/আধিক্য ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশাপাশি কিছু বেসিক বিষয়ে গবেষণা করাও অতীব জরুরি। যেমন : মশারা সত্যিই কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে কি না? কোন প্রজাতির মশা কোথায়, কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? কীটনাশকের রিকমেন্ডেড ডোজ পরীক্ষাকরণ ইত্যাদি সব সময় পরিচালনা করতে হবে। বিভিন্ন টারগেট এরিয়ায় মশা কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এ্ই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিসটেন্স রেশিও) কেমন, তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। কীটনাশক (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) নির্বাচন করার আগে তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করতে হবে।  কোন কীটনাশক (এডাল্টিসাইড/লার্ভিসাইড) কোন মশা/লার্ভাকে সফলভাবে দমন করতে পারে, তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট করে (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) জেনে নিতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।

২. মশার সার্ভিলেন্স পরিচালনা

মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণার বিষয় হচ্ছে- মশার সারভিলেন্স। এডিসসহ অন্যান্য মশার (এডাল্ট এবং লার্ভা) সারভিলেন্স কার্যক্রম নিয়মিত (সারা বছর) পরিচালনা করতে হবে এবং তা মনিটরিং করতে হবে। অভি ট্র্যাপ (ডিম সংগ্রহের জন্য) ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মশার উপস্থিতি জানা যেতে পারে। বিভিন্ন এরিয়ায় জমানো পানিতে লার্ভার উপস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। হোস্ট-সিকিং মশা (মানুষ বা প্রাণীদের কামড়ায়) ও এগ-লেইং মশা (ডিম পারা মশা) ধরার জন্য বিভিন্ন ট্র্যাপ (মশা ধরার ফাঁদ, যেমন : লাইট ট্র্যাপ, বিজি ট্র্যাপ, গ্রাভিড ট্র্যাপ) ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে কোন এরিয়ায় কী কী প্রজাতির মশা রয়েছে, এদের আধিক্য কেমন, এমনকি কোথাও জীবাণুবাহী মশা আছে কি না (ভাইরাস সারভিলেন্স) তাও জানা যাবে। জীবাণুবাহী মশা শনাক্তে আরবো ভাইরাল টেস্ট করতে হবে। নিয়মিত সারভিলেন্স করে কোথায়, কোন প্রজাতির মশা আছে, তা জেনে নির্দিষ্ট কীটনাশক (ডোজসহ) প্রয়োগে সুপারিশ করতে হবে।

৩. মশা নিধনে নতুন প্রযুক্তি/পদ্ধতির পরীক্ষামূলক ব্যবহার

মশা নিধনে প্রতিনিয়তই বিশেষ বিশেষ প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে  বর্তমানে কীটনাশকের (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) পাশাশাশি জৈবপ্রযুক্তি নির্ভর ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যহত করে) ব্যবহার কার্যকরী হয়ে উঠছে। চীন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, মালেশিয়াসহ অনেক দেশে এর সফল কার্যক্রম চলছে। তা ছাড়া বর্তমানে মেল স্টেরাইল টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে কিন্তু ডিম উৎপাদন হবে না) পদ্ধতির সফল ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার মশক প্রিডেটরস—যেমন : মশক মাছ (গাপ্পি, গ্যামবুসিয়া ইত্যাদি) ইত্যাদির বাণিজ্যিক ব্যবহার বিদেশে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশেও এদের ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে (ল্যাব রিসার্চ করে) চালু করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

মশার কামড় বা এর রোগ থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও প্রোটেকশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিই প্রথম প্রয়োজন। এডিস একটি ঘরোয়া মশা এরা বসতবাড়ীতে বা এর আশপাশে বংশবিস্তার ও উড়তেই অভ্যস্ত। তাই বাড়ীর প্রত্যেককে এডিস মশা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখতে হবে। শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষ এককভাবে মশা নিধন করতে পারবে না। আমাদের নিজস্ব দায়িত্বটুকু অবশ্যই পালন করতে হবে। মহিলাদেরও এই নিধন কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিজিট করে মশার প্রজাতি, মশার আক্রমণ, জীবন-চক্র, জীবানু-রোগ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সর্বোপরি সবাইকে এগিয়ে এসে মশা নিধন কার্যক্রম সফল করতে হবে।

লেখক :  সহযোগী অধ্যাপক (ডেপুটেশন), কীটতত্ত্ব বিভাগ, পবিপ্রবি, বাংলাদেশ।