জুয়াপাড়া!!
ঢাকা, আমাদের রাজধানী। যার সঙ্গে দেখা হয়, এখন সে-ই বলে এ শহর বড় অচেনা লাগে। যেসব জায়গাকে একসময় ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বলা হতো, সেই মতিঝিলের ক্লাবপাড়া, সেখানে নাকি এক অন্য রকম জমকালো ও ব্যস্ত জীবন গড়ে উঠেছিল। না, খেলার সাফল্যে কোনো ঔজ্জ্বল্য নয়, জুয়ার রাজ্য হয়ে উঠেছিল এই পাড়া। খেলায় খরাবিধ্বস্ত হলেও এই ক্লাবপাড়া হয়ে উঠেছিল ধনীদের গ্রাম।
ফকিরাপুল ইয়ংমেনস দিয়ে শুরু হয়ে একটা একটা করে ক্লাবের দরজা খুলছে আর ক্যাসিনো নামের জুয়া রজনীর গল্প উন্মোচিত হচ্ছে আমাদের সামনে। খেলাধুলার সঙ্গে সেই ছোট থেকেই নাড়ির টান। সেই কবে থেকে আমাদের ক্লাবপাড়ায় যাতায়াত, কিন্তু এমন ক্লাব ছিল না সেসব। ফুটবল, ক্রিকেটের তুমুল প্রতিযোগিতা আর আলোচনা ছাড়া আর কিছু ছিল না এই পাড়ায়। ভাগ্যিস আজ যে চিত্র দেখছি, সেই ক্লাবপাড়া আমরা দেখিনি। নিজেদের সত্যিই খুব ভাগ্যবান মনে হয়।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে খেলার প্রতি মনোভাব বদলায়। তাই বলে এইভাবে? সাবেক ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম বলেছেন, ‘একসময় ভিক্টোরিয়ায় খেলেছি। তখন সপ্তাহে একদিন হাউজি হতো। এতেই আমাদের অস্বস্তি হতো। তবুও মেনে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে ক্লাবেরও কিছু আয় দরকার। আমরা ক্লাব থেকে সরে থাকতাম, হাউজি শেষ হলে ফিরতাম। কিন্তু ক্যাসিনো নামের এমন জুয়ার আসর! ভাবতেই পারছি না।’
হ্যাঁ, তিনি ভাবতে পারছেন না। কিন্তু যারা ভেবেছে, তারা কামিয়ে নিয়েছে। তারা ক্লাব দখলে নিয়েছে ফুটবল-ক্রিকেটের জন্য নয়, জুয়ার জন্য। এখন ক্লাব মানেই ক্ষমতা দখলের কেন্দ্র। রাজনৈতিক নেতারা এর দখলে নিয়ে বাণিজ্য করেছেন, চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করেছেন। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া কোনোদিন খেলোয়াড়ও ছিলেন না, ক্রীড়া সংগঠকও ছিলেন না। কিন্তু তাঁর দখলে ফকিরাপুল ইয়ংমেনসের মতো একটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। যে ক্লাবটির দাপট ছিল মাঠে, বড় দলগুলোও ভয় পেত, সেই ক্লাব এখন ঘৃণিত। যে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফুটবল খেলেছেন, সেই ক্লাবে বঙ্গবন্ধুর নাম জপা শাসক দলের নেতার ক্যাসিনো বাণিজ্য করেছেন। যে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবেগে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে যত রকমের অসভ্যতা।
আমাদের সব বড় স্বপ্ন ছোট রাজনীতির কাছে এভাবেই পরাভূত হয়েছে। এই ছোট রাজনীতির প্রবণতাটি চরম ক্ষতিকর। বস্তুত, এটাই সর্বনাশের মূল। এই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজই ব্যাধিগ্রস্ত দল উৎপাদন করেছে, তাদের নেতারা হয়েছেন দুর্বত্ত। ক্লাবপাড়ায় যখন অভিযান, তখন একইভাবে উত্তাল বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। জাহাঙ্গীরনগর, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং খোদ রাজধানীর বুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়—কোনোটি থেকেই কোনো ভালো খবর নেই। যে সমাজ শিক্ষাক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চাঁদাবাজি আর অপরাজনীতির প্রাঙ্গণ হিসেবে দেখে, সেই সমাজের অবক্ষয় সম্বন্ধে আর কোনো সংশয় থাকে না।
রাজনীতির দানব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে। সেই রাজনীতি ঢুকেছে ক্লাবপাড়ায়ও। হ্যাঁ, আগে যে ক্লাব রাজনীতি ছিল না, তা নয়। কিন্তু তার একটা সুস্থতা ছিল। সেই রাজনীতি ছিল আদর্শকে ভিত্তি করে। এবং তার কতগুলো সহবত ছিল। কি বামপন্থী, কি আওয়ামী লীগ, কি বিএনপি—সবারই নজর ছিল খেলার মান্নোনয়ন। সেসব কোথায় উধাও হয়ে গেল। ফলে খেলার জন্য যে একটা সুস্থ পরিবেশ দরকার, সেটা বিদায় নিল। ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা এমনই মানুষ যে তাঁদের রুচিতে এতটুকুও বাধল না এসব করতে?
ক্লাবপাড়ার এই পরিণতি প্রমাণ করে, ক্রীড়াক্ষেত্রে আমরা যেমন এক আত্মবিস্মৃত জাতি, তেমনই অদূরদর্শী। খেলাও যে কৃষ্টির অংশ, সেটা ভুলে গেছি আমরা। ফুটবল নিয়ে আর গর্ব করার উপায় নেই। আমরা এখন পেছনের সারিতে চলে গিয়েছি। এমনটা চললে ক্রিকেটও যে কোথায় হারাবে, সেই আশঙ্কা করি। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলার বিষয় অপরাধের দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু খেলার দপ্তর যাদের হাতে, তারা কি জবাব দেবেন?
আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ষোলোআনা পশ্চাৎগামী, আমরা ক্রীড়াজগতেও ক্যাসিনোর আলোয় অগ্রগামী। ক্লাবগুলো দখল করে যারা এসব করেছে, তারা একটি বিষচক্র।
পরিত্রাণের উপায় কী? অনেকে বলবেন, জনমত গড়ে তোলা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু ঘটলে আন্দোলন হয়, কিন্তু ক্লাবপাড়ায় খেলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আন্দোলন কোথায়? এসব আর চলতে পারে না। প্রতিটি ক্লাবের মর্যাদা রয়েছে, স্থানীয় মানুষদের চিত্ত বিনোদনে এই ক্লাবগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রয়োজনকে খাটো করা হয়েছে বলেই এসব ঘটেছে। আমরা বিশ্বাস করি, সমাজে এখনো সচেতন মানুষ একেবারে হারিয়ে যাননি। তাঁদের উচিত এই নৈরাজ্যের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কঠিন কাজ। কিন্তু করতে হবেই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।