সততা

Looks like you've blocked notifications!

যুবলীগ নেতা ক্যাসিনো খালেদ, টেন্ডার কিং জি কে শামীম বা পুরান ঢাকার দুই আওয়ামী লীগ নেতার কোটি কোটি টাকা আর বিপুল সম্পদ দেখে আমরা এখন স্তম্ভিত। আমরা ভাবছি, এই ছোটখাটো নেতারাই যদি এত টাকার মালিক বনে যায় রাতারাতি, তাহলে বড় রুই-কাতলারা না জানি কী করেছে!!

আমরা অনেকেই বলছি, জানতে চাচ্ছি চলমান এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের গন্তব্য কোথায়? কোন পর্যন্ত যাবে, সেটা প্রধানমন্ত্রীই আসলে জানেন। তবে আমি মনে করি, এটি ঠিক প্রচলিত অর্থে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি আবার দলীয় প্রধান, তিনি নিজ দলের দুর্বৃত্তদের সাবধান করতে এই সাহসী উদ্যোগটা নিয়েছেন, যা অনেক দলপ্রধান করতে উদ্যমী হবেন না।

প্রধানমন্ত্রী দলের নেতাকর্মীদের একাংশ এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি নিয়ে চিন্তিত। শনিবার নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের ম্যারিয়ট মারকুইজ হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। আমরা ব্যাপকভাবে উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছি। যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প আমরা নিচ্ছি, তার প্রতিটি টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যয় হতো, ব্যবহার হতো, আজকে বাংলাদেশ আরো অনেক বেশি উন্নত হতে পারত। এখন আমাকে খুঁজে বের করতে হবে এখানে কোথায় লুফুল, কোথায় ঘাটতিটা, কারা কোথায় কীভাবে এই জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

এসবের বাইরে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটা সবারই ভাবনা। তিনি বলেছেন, ‘একজন অসৎ মানুষের দৌরাত্ম্যে যারা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চায়, তাদের জীবনযাত্রাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, ছেলেমেয়েরা ছোট শিশু, তারা তো আর এতটা বোঝে না। ভাবে, ওরা এভাবে পারে তো আমাদের নেই কেন। এটা স্বাভাবিক, তাদের মনে এ প্রশ্নটা জাগবে। অত ছোট ছোট বাচ্চা, তারা সৎ-অসতের কী বুঝবে। তারা ভাবে, আমার বন্ধুদের এত আছে, আমাদের নেই কেন? স্বাভাবিকভাবে মানুষকে অসৎ উপায়ের পথে ঠেলে দেবে।’

কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো বলেছিল, ‘মানুষের বস্তুগত অস্তিত্বের পরিবর্তন তার সামাজিক সম্পর্ক ও জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণাগুলোর, এককথায় তার চৈতন্যের পরিবর্তন ঘটে।’ আমাদের শাসন ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক না। কিন্তু এ কথা আন্দাজ করা যায় যে, মানুষের চৈতন্যের পরিবর্তন ঘটছে। আমাদের সংবিধানে বিচারালয়ে সেই শপথটাই পাঠ করানো হয়—যাহা বলিব সত্য বলিব...। বরাবরই বলা হয়—আইন, বিচার ও প্রশাসনে এই সততার ন্যায়বিচারই প্রধান। কিন্তু সমাজ কি সততার মূল্য দেয়? আজ অসততা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অসৎ মানুষের দাপটে মনুষ্যত্বের পথ যেন অপ্রয়োজনীয়, মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। বিশৃঙ্খলা, অসাম্য, অসংগতিই যেন এখনকার সভ্যতা।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ হবে। কিন্তু এত উন্নতির পরও দুর্নীতি মাপার প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবমতো বিশ্বের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
আমরা যখন ক্যাসিনো-কাণ্ড, টেন্ডার লুট বা দলের ভেতর পদ-বাণিজ্য নিয়ে সরব, তখন আমরা খুব কমই কথা বলছি আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে। আর্থিক খাতে যে বড় বড় দুর্নীতি ঘটেছে, তা নিয়ে মনে হচ্ছে আমাদের চারদিকের সমাজের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। এখান থেকেই অনেকগুলো ভাবনা আসে। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, দুর্নীতি না হলে আরো বেশি উন্নয়ন হতো, তখন আমরা আশা করতে চাই যে সরকার নতুন করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে, উন্নয়ন আর দুর্নীতি হাতে হাত ধরে এগিয় চলতে পারে না।
দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান বা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর দীর্ঘস্থায়ী খারাপ ফল আছে। হঠাৎ কোনো একটা বিষয় সামনে এলে তা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি, তারপর সব ভুলে যাই। ভুলে যাই যে আরো বড়, আরো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিবাজরা রাষ্ট্রের, জনগণের ক্ষতি করেও বড় বড় জায়গায় নিজেদের অবস্থান পাকা করতে সক্ষম হয়েছেন।

এ বিষয়টাই জটিল। যে ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে, দিনমান পরিশ্রম করে, সাতসকালে বাইরে গিয়ে গভীর রাতে ঘরে ফিরে আবার ভোরে কর্মস্থলে যাওয়ার সংগ্রাম করে কেবল মাস গেলে কয়েক হাজার টাকা বেতনের জন্য, তার কাছে তার চেয়ে অযোগ্য রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের বাসা থেকে যখন কোটি কোটি টাকা, স্বর্ণ আর ব্যাংকের মতো ভল্ট বের হয়, তখন সে আহত হয়, হতাশ হয়, সে দুর্বৃত্ত হওয়ার পণ করে।

আমাদের কোথাও রোল মডেল নেই। আমাদের অনেক উপাচার্যও কদর্য। তাই সব রকমের দুর্নীতি থেকে মুক্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা মানুষদের কোনো সম্মান নেই আজ। সেসব মানুষ আজ অবহেলিত। শুধু রাজনীতি নয়, প্রায় সব পেশায় যেনতেন প্রকারে অতিমাত্রায় রোজগার করা মানুষের ফুটানিই এখন আদর্শ। নিজের পরিবারের মানুষজনের কাছেই এখন সৎ মানুষ মূল্যহীন।

দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থানকে ভঙ্গুর করে দেওয়ার চক্রান্ত এটি। এই ষড়যন্ত্র রুখবে কে?

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।