বাঙালি নোবেলজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি

Looks like you've blocked notifications!

বাঙালির বিশ্বজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারাটা আমাদের সবার জন্যই অতি অবশ্যই আনন্দের। এই উপলক্ষটা আরেকবার এনে দিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাঙালি এবং আমেরিকান অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি। শতবর্ষের ইতিহাসে ভারত বাংলাদেশ মিলে চতুর্থ বাঙালি যিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন, ড. মুহম্মদ ইউনূসের পর নোবেল প্রাইজে ভূষিত হলেন। 

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) ফোর্ড ফাউন্ডেশনে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত। অর্থনীতিতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য এ বারের নোবেল পেলেন অভিজিৎ, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এস্তার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমার।

বিশ্বের নামী সব সাময়িকীতে অসংখ্য লেখা প্রকাশ হয়েছে অভিজিৎ ব্যানার্জির। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং পোভার্টি, ‘হোয়াট দ্য ইকোনমি নিডস নাউ’ শিরোনামের যৌথ সম্পাদনার বই ছাড়াও নিজের লেখা বই আছে চারটি। এর মধ্যে দারিদ্র্য নিয়ে অভিজিৎ ও তাঁর নোবেলজয়ী স্ত্রী এস্তারের লেখা বহুল প্রশংসিত ‘পুওর ইকনোমিকস’ বইটি জিতেছে গোল্ডম্যান স্যাকস বিজনেস বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কার।

সুইডিশ রয়্যাল একাডেমি অর্থনীতিতে নোবেলের জন্য এই তিনজনের নাম ঘোষণা দিয়ে বলেছে, ‘বৈশ্বিক দারিদ্র্য নিরসনে এই ত্রয়ী আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। মাত্র দুই দশকে তাদের পরীক্ষামূলক গবেষণা উন্নয়ন অর্থনীতির মোড় পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। এটা গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষকরে এই তিনজনের পরীক্ষামূলক গবেষণা পদ্ধতি ৫০ লাখের বেশি ভারতীয় শিশুকে উপকৃত করেছে।

৫৮ বছর বয়সী অভিজিৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৮৮ সালে পিএইচডি অর্জন করেন হার্ভার্ড থেকে। অভিজিৎ ব্যানার্জি ১৯৬১ সালে কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা নির্মলা ব্যানার্জি ছিলেন সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর বাবা দীপক ব্যানার্জি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক।

অভিজিৎ ব্যানার্জির মা অর্থনীতির অধ্যাপক নির্মলা ব্যানার্জি পুত্রের নোবেল প্রাপ্তির পর সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘অভিজিৎ আমার ছেলে নয়, সবার ছেলে। দারিদ্র্য দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে অভিজিৎ। ওর গবেষণার বিষয় নিয়ে প্রায়ই আমার সঙ্গে কথা বলে। কী করা উচিত, কী উচিত নয়, সেই বিষয় নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করা যেতে পারে, সেই বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণা করেছিল অভিজিৎ। তার গবেষণার ফলস্বরূপ, ৫০ লক্ষের বেশি ভারতীয় শিশু উপকৃত হয়েছে।’

অভিজিতের নোবেল পাওয়ার খবরে উচ্ছ্বসিত ভারতের বিদ্বৎ সমাজ। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধীর’ লেখক রামচন্দ্র গুহ তাঁর টুইটারে লিখেছেন, ‘লেখাপড়ায় অসামান্য তিনি। এর পাশাপাশি হাতের রান্নাও দারুণ। আর ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি। ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বোত্তম দিকগুলোই তিনি তুলে ধরেন।’

কলকাতার ভূমিপুত্র অভিজিৎ ব্যানার্জিকে টুইটারে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। নিজের টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জিতে আরো এক বাঙালি বাংলার মুখ উজ্জ্বল করলেন। অভিজিৎকে অনেক শুভেচ্ছা। আরেক বাঙালি দেশকে গর্বিত করলেন। আমরা উচ্ছ্বসিত।

১৯৯৮ সালে দুর্ভিক্ষ, মানব উন্নয়ন তত্ত্ব, জনকল্যাণ অর্থনীতি ও গণদারিদ্র্যর অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে গবেষণা এবং উদারনৈতিক রাজনীতিতে অবদান রাখার জন্য নোবেল পান বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সেই দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার জন্যই তাঁরই ছাত্র অভিজিৎ ব্যানার্জি নোবেল অভিধায় ভূষিত হলেন এবার।। অমর্ত্য সেন যে তাঁকে নানাভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, সে কথাও বলতে ভোলেননি অভিজিৎ। নোবেল পেয়েও দারুণ উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে নারাজ তিনি। নোবেল পাওয়ার পর তাঁর ছেলেবেলার বাংলার কথা তিনি ভুলে যাননি। গণমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, 'পশ্চিমবঙ্গে আমি একাধিকবার নানাভাবে গবেষণা করেছি। আমাদের কাজে অন্যভাবেও চিন্তা করতে তো হয়, সেখানে আমার ছোটবেলা-বড় হয়ে ওঠা নানাভাবে সাহায্য করেছে।'

নিজের কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়েও অভিজিত বলেছেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০ বছর গবেষণা করেছি। ভারত, চীন, সাউথ আফ্রিকা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ঘানা এই সমস্ত দেশে আমি বারবার গিয়েছি।' তবে যে কাজে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিযুক্ত থাকায় আজকের এই সাফল্য। সেই বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের বিষয়ে বলতে গিয়ে কঠিন বাস্তবের কথাই জানান অভিজিৎ, 'একজায়গায় বসে বোতাম টিপে বিশ্ব দারিদ্র্য দূর করা যায় না। ফ্রি মার্কেট করে দিলেই সব ভালো হয়ে যাবে বলে যে ধারণা চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তা আসলে সঠিক নয়। একটা একটা ক্ষেত্র ধরতে হবে, সমাধান করতে হবে।' আর এবিষয়ে তিনি যে আশাবাদী, তা জানাতেও ভোলেননি তিনি।

স্বামী স্ত্রীর একসাথে নোবেলজয়ের ঘটনা ইতিহাসে খুবই স্বল্পসংখ্যক। এই নিয়ে মাত্র পঞ্চম দম্পতি হিসেবে একই বছর একই বিভাগে নোবেল পেলেন অভিজিৎ দম্পতি। এস্তারের গবেষণার বিষয় ছিল, ‘দারিদ্র্যে দূরীকরণে সামাজিক নীতি নির্ধারণ’। দীর্ঘদিন সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন অভিজিৎ এস্তার।

অভিজিতের জন্ম কলকাতায় ১৯৬১ সালে। এমআইটির শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত অভিজিৎ। তিনি আব্দুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাবের সহপ্রতিষ্ঠাতা। ইনোভেশন ফর পোভার্টি অ্যাকশনের গবেষক। কনসোর্টিয়াম অন ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমস অ্যান্ড পোভার্টির সদস্য অভিজিৎ ব্যানার্জি।

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক সংস্কারের করা সমালোচক অভিজিৎ ব্যানার্জি জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট অ্যাজেন্ডা কর্মসূচিতে সচিবের বিশিষ্ট প্রতিনিধি প্যানেলেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। অভিজিতের শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতাতেই। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। পরে পড়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করে যেতে পারে এমন গবেষণার ফল পাচ্ছে তাঁর নিজের দেশ ভারতেরই অন্তত ৫০ লাখ শিশু। এরচেয়ে বড় সার্থকতা আর কী হতে পারে? তাঁদের গবেষণার সুফল পাক বিশ্বের শতকোটি দরিদ্র মানুষ। নিশ্চিতই আমরা বাঙালি নোবেল উইনারের জন্য গর্বিত। এই বাঙালি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ও তাঁর দুই সতীর্থকে আন্তরিক অভিবাদন জানাই।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।