যুবলীগ কোন রাজনীতি করে?
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সংগঠন কোন রাজনীতি করে? কিংবা আপনার সংগঠন আওয়ামী লীগের কোন কাজে লাগে? তিনি অনেকগুলো প্রসঙ্গ টেনেছেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, যুবকদের রাজনীতিমুখী করতে কাজ করে তার সংগঠন। কিন্তু কী সেই রাজনীতি, সেটা আর বলতে পারেন না; পারেননি সংগঠনের গঠনতন্ত্রে কী ধরনের রাজনীতির কথা বলা আছে তা-ও জানাতে।
ইতিবাচক, নেতিবাচক মিলিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির একটা ধারণা জনমনে থাকলেও যুবলীগ সম্পর্কে সেই অর্থে কোনো স্বচ্ছ ধারণা রাজনীতি অঙ্গনে ছিল না। এখন ক্যাসিনোকাণ্ডের পর যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে যে যুবক আগামীর বাংলাদেশের জন্য বড় স্বপ্ন দেখে, সে এই সংগঠন করতে আগ্রহী হবে না। যুবলীগ যুবকদের সংগঠন, অথচ এর সভাপতির বয়স ৭২ বা বাকি কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশই ৭০ ছুঁই ছুঁই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুদ্ধি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে যুবলীগ থেকে এখন বিড়াড়িত সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীসহ কয়েকজন। বলা হলো, এখন থেকে বয়স ৫৫ পেরোলেই কেউ আর যুবলীগ করতে পারবেন না। এমনকি নেতৃত্বেও আসতে পারবেন না কেউ। এর আগে যুবলীগে যোগদানের বয়সসীমা থাকলেও তা মানা হয়নি। রোববার গণভবনে যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
যুবলীগ কেমন রাজনীতি এত দিন করে এসেছে, সেটাও বোঝা গেল এই সিদ্ধান্ত থেকে। সংগঠনের নেতৃত্ব এত বছর ধরে নিজেদের একটা বয়সসীমা নির্ধারিত করতে পারেনি। সেটাও করে দিতে হয়েছে শেখ হাসিনাকেই। আসলে তাঁরা কোনো রাজনীতিই করেননি। সংগঠন করেছেন পদপদবি আর আধিপত্য কায়েমের জন্য।
কী করেছে এই নেতৃত্ব? একজন বয়স্ক বিভ্রান্ত নেতার দায়িত্বজ্ঞানহীন আস্ফালন ছাড়া এই সংগঠনে কোনো রাজনীতির চর্চাই ছিল না। তিনি যেভাবে বিতাড়িত হয়েছেন, তাতে তিনি এখন কোন বর্ষাতির আড়ালে নিজেদের মুখ লুকাবেন, হয়তো তা-ও ঠিক করতে পারছেন না।
শেখ ফজলুল হক মনি যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর কাঠামোও আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী সংগঠন থেকে আলাদা। এর প্রেসিডেন্ট নেই, আছে চেয়ারম্যান পদ। এর সম্মেলন হয় না, হয় কংগ্রেস। সংগঠনের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা বলতে কিছু নেই বলেই সাত বছর ধরে সেই কাঙ্ক্ষিত কংগ্রেসও হয় না।
আমার মনে হয়, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যুবলীগ নেতারা একটা বিষয় বুঝতে পারেননি যে ছাত্রদের মধ্যে হানিকর দলীয় রাজনীতির পত্তন করা ও সেই উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করা যত সহজ, যুবসমাজের মাঝে সেটা করা ততটা নয়। যুবলীগ আসলে কখনো যুবসমাজের রাজনীতিটাই সংজ্ঞায়িত করতে পারেনি। সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারলে আর রাজনীতি ঠিকভাবে করলে, অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও মেধাবী যুবসমাজ এই সংগঠনে আকৃষ্ট হতো, যাদের কেউ কেউ পরে দলের উচ্চতর নেতৃত্বে আসন পেতে পারত। ছাত্র রাজনীতির মতো করে যুব রাজনীতি করলে সৎ, নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী যুবকের কাছে সেই রাজনীতি পৌঁছাতে পারবে না।
সংগঠন ঠিক নেই, রাজনীতি নেই, আছে ব্যবসা, দখলবাজি, হানাহানি। এমন রাজনীতি যৌবনের স্বাভাবিক মানবিকতা ও সমাজবোধ ডুবিয়ে দেয় সহিংসতা আর বিদ্বেষের গহ্বরে। এ দেশে এত যুবক, জনসংখ্যার বড় অংশই তারা। কিন্তু তাদের একটা খুব ছোট অংশই রাজনীতিতে সক্রিয়। এর কারণ এই নয় যে তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয় বলে রাজনীতি সমর্থনও করে না বা তারা রাজনীতি সম্বন্ধে উদাসীন। এটুকুই বলা যায়, তারা দলাদলি হানাহানির বাইরে থাকতে চায়, সৎ থাকতে চায়। যুবলীগ বা যুবদল যা-ই হোক, যুবকদের আকৃষ্ট করে না প্রচলিত রাজনীতি বা সাংগঠনিক ধারা। আমি মনে করি, এই প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ইতিবাচক সমাজবোধের বীজ। দলীয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ যুবসমাজ দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি বা জননিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়ে পথে নামতে চায়। আজকের আধুনিক যুবসমাজ রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতা দখলের নিরিখে না দেখে সৎ ও নিরলসভাবে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিতে দেখতে চায়।
কেমন হবে তবে সেই রাজনীতি? যুব সংগঠনকে নিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বোধের বিকাশমূলক কর্মসূচি। ক্যাসিনোকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠছে। কিন্তু আমি এর মাঝেও ইতিবাচক কিছু দেখি। এই যে একটা আলোচনা শুরু হয়েছে, সেটাই ভরসার কথা। অনাচার ও দুর্নীতির লীলাক্ষেত্র হওয়াই যে আমাদের রাজনীতির ভবিতব্য নয়, এ ধারণাটা অন্তত চিন্তার আওতায় এসেছে। শেষ অবধি কী হবে আমরা জানি না, কিন্তু রাজনীতির ধারায় অন্তত কিছু রূপান্তর ঘটবে হয়তো। এর বেশি আশা হয়তো করতে পারছি না।
যাঁরা যুবলীগের নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁরা আগামী কংগ্রেসে নেতৃত্ব নির্বাচনের পাশাপাশি প্রত্যাশিত সেই রাজনীতিটা নিয়ে আসবেন বা প্রস্তাব করবেন এ দেশের যুবসমাজের জন্য, সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।