নুসরাত হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়

Looks like you've blocked notifications!

নিষ্পাপ ও নির্দোষ একটি মেয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাঁকে ডেকে ছাদে নিয়ে কয়েকটা অমানুষ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। নুসরাত জাহান রাফির সঙ্গে যা ঘটেছে তা প্রাচীন বা মধ্যযুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। কত সুচারু পরিকল্পনা করে মানুষকে হত্যা করা যায়।

পেশায় আমি সাংবাদিক। আইন, বিচার বিভাগ, বিচার ব্যবস্থা— এ সবই আমার কাজের ক্ষেত্র। নুসরাতকে হত্যা ও এর আগে যা ঘটেছে তার সঙ্গে সবকিছুই পড়া ও জানার চেষ্টা করি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে গিয়ে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্তৃক শ্লীলতাহানির শিকার হন তিনি। এর বিচার চাওয়ায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হলো তাঁকে।

রায়ের অপেক্ষায়

ঘটনার পর থেকে  আমাদের এনটিভির ফেনী প্রতিনিধি ওছমান হারুন মাহমুদ ভাইয়ের কাছ থেকে এ মামলার সব খোঁজ খবর রাখি। মামলাটি রায়ের জন্য তারিখ পড়ার পর থেকে অপেক্ষায় থাকি কখন আসবে সে দিনটি।

একজন আইন বিষয়ক রিপোর্টার হিসেবে এ মামলা কভারেজ করার জন্য মুখিয়ে আছি। অবশেষ রায়ের এক সপ্তাহ আগে পরিকল্পনা নেওয়া শুরু করি। এ নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নিউজের পরিকল্পনা করি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বার্তাবিভাগের মাহবুব আলম রনি ভাই এবং আহমেদ আল আমীন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। উনারাও পরামর্শ দেন এনটিভি অনলাইনের প্রধান ফকরদ্দীন আহমেদ জুয়েল ভাইয়ের কাছে গিয়ে নিউজ কভার করার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা নিয়ে কথা বলার জন্য। পরিকল্পনা জুয়েল ভাইকে জানাই। তিনিও পরিকল্পনা দেখে খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলেন। এর পরই পরিকল্পনা মাফিক ২৩ অক্টোবর রওয়ানা হয়ে দুপুর ১২টায় ফেনী পৌঁছাই। আগের পরিকল্পনামতো ফেনী প্রতিনিধি ওছমান হারুন ভাই আমাদের জন্য হোটেল বুকিং করে রেখেছেন। ফেনীর ট্যাংক রোডে হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে সহকর্মী ফটোগ্রাফার ইব্রাহিম ভাইকে নিয়ে রওনা হলাম সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। ফেনী থেকে নুসরাতদের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২৩ কিলোমিটার। অফিসের গাড়িতে করে রওনা ফেনীর সোনাগাজী নুসরাত জাহান রাফির গ্রামের বাড়িতে। যাওয়ার সময় মনের মধ্যে কল্পনা করতে থাকি নুসরাতকে কীভাবে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় পোড়ানো হলো। সেসব দৃশ্য চোখের সামনে মনে হয় ভাসছে। সোনাগাজীতে পৌঁছার আগে গাড়িতে বসেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নুসরাতদের বাড়ির পাশাপাশি মাদ্রাসা দেখার। আবার চিন্তা করছি বাড়িতে গিয়ে নুসরাতের পরিবারের কাউকে পাব কি না? ওর মাকে যদি পাই তাহলে কী প্রশ্ন করব। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো তাঁর কোনো ভাষা আছে কি না? ভাবতে ভাবতেই গাড়ি চলছিল গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। এরমধ্যে ফেনী প্রতিনিধি ওছমান হারুন ভাই বললেন আর মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছাব। আমাদের গাড়ি যখন নুসরাতদের বাড়িতে পৌঁছাল তখন দুপুর দেড়টা থেকে একটু বেশি। বাড়ির দরজায়  যখন পৌঁছালাম গাড়ি থেকে নেমে দেখি বাড়ির দরজায় পুলিশের চেকপোস্ট। কেউ প্রবেশ করতে হলে পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। পুলিশের কাছে পরিচয় দিয়ে নাম ঠিকানা দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।

‘হাজার মেয়ের মধ্যে ওকে আলাদা করা যেত’

পুরো বাড়িতে তিনটি টিনের ঘর। নুসরাতদের ঘরটি বাড়ির দক্ষিণ পাশে। টিনের ঘর হলেও বাড়ির আঙিনাগুলো বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন। ঘরের ভেতরেও অনেক পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো। মনে মনে ভাবছি এ আঙিনা নুসরাতের পদাচরণে মুখর ছিল সব সময়। অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করি। ঘরে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বয়স প্রায় ৯০ এর কাছাকাছি। সালাম দিয়ে পরিচিত হতে জানতে পারলাম তিনি নুসরাতের দাদা মোশাররফ হোসেন। বয়সের ভারে প্রায় নুয়ে পড়েছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। সম্প্রতি একটি মসজিদের ইমামতি থেকে অবসর নিয়েছেন। ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি একটি মসজিদে ইমামতি করে আসছেন। দুই মাস আগে অবসরে গেছেন। নুসরাতের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মোশাররফ হোসেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমার একমাত্র নাতনি ছিল নুসরাত। অনেক নাতির মধ্যে আমার একটি মাত্র নাতনি। হাজার মেয়ের মধ্যে ওকে আলাদা করে বেছে নেওয়া যেত। বাড়িতে যখন আসতাম সারাক্ষণ দাদু দাদু করে লেগে থাকত। এসব কথা বলতে বলতে তিনি অনেকটা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে নুসরাতের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই জানালে তিনি ডেকে দেন। এরপর নুসরাতের মা শিরিন আক্তার আসেন কথা বলার জন্য। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠেন ‘বাবা এখনো বেঁচে আছি।’

‘এমন জানলে পরীক্ষার জন্য পাঠাতাম না’

এরপর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। নুসরাত সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি একাধারে বলে যাচ্ছেন, ‘নুসরাত আমার তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকেই ও অনেক নম্র ও ভদ্র ছিল। পরিবারের আনুগত্যের বাইরে কিছুই ছিল না। মা-বাবা, ভাই ছাড়া সে কিছুই চিন্তা করতে পারত না। তার স্বপ্ন ছিল পড়া লেখা করে মানুষ হওয়ার। সে আমাকে প্রায়ই বলত, মা আমি অনার্স শেষ করে ম্যাজিস্ট্রেট হবো। দাখিল পরীক্ষায়ও নুসরাত ভালো রেজাল্ট করেছে। আলিমে ভর্তি হওয়ার পর এ মাদ্রাসায় যখন ভর্তি হলো তখনি নুসরাতের জীবন অনেকটা বিপন্ন হয়ে উঠে। মাদ্রাসা আসা যাওয়ার পথে অনেক বখাটে ডির্স্টাব করত। সে তার ভাইকে সবই বলত। কেননা বড় ভাই নোমান ছিল তার বন্ধু। তিন ভাই বোন মিলে খেলাধূলা করত। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যখন নুসরাতকে রুমে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে তখনি নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে উঠে। সেটাই তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। এ ঘটনায় মামলার পর সিরাজ আমার নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আমি যদি জানতাম তাহলে নুসরাতকে পরীক্ষা দিতে যেতে দিতাম না। নুসরাত পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে গেছে, মা আমি যাই। এ যাওয়াই যে তার শেষ যাওয়া। বাড়িতে আর জীবিত ফেরেনি। নুসরাতের মা কাঁদছিলেন।

শিরিন আক্তার বলেন, বাবা আমি নুসরাত হত্যার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমার মেয়েকে যেভাবে হত্যা করেছে এসব হায়েনাদেরও যেন সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে আগুনে পড়িয়ে মারা হয়। তা-না হলে এর যন্ত্রণা এরা বুঝবে না। আমার মেয়ে হাসপাতালে আমাকে বলেছে; মা আমি হয়তো বাঁচব না, যারা আমাকে পুড়িয়েছে তাদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো কিছুই খুঁজে পেলাম না। মনের অজান্তে দেখি নিজের চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে । এরপর নিজেকে সামলিয়ে নুসরাতের স্মৃতিচারণা করতে তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়ে নুসরাতের রুমে প্রবেশ করলাম। রুমে প্রবেশ করতেই প্রথমে পড়ার টেবিলের দিকে চোখ আটকে গেল। সাজানো গোছানো শোয়ার রুমের পাশে পড়ার টেবিল। টেবিলে থরে থরে সাজানো রয়েছে আলিম পরীক্ষার বই, গাইড,খাতা-কলম। পড়ার টেবিলের পাশের হার্ডবোর্ডের দেওয়ালে অসংখ্যবার মা বাবা ভাই বোন নিয়ে লেখা। ‘মা আমার চোখের মনি’। ‘মা বাবা ভাই বোন’।

মা-বাবার প্রতি নুসরাতের অসংখ্য ভালোবাসার চিহ্ন থাকলেও নেই এ বাড়িটিকে মাতিয়ে রাখা নুসরাত। মানুষরূপী কিছু পশুর বর্বোরোচিত লালসার শিকার হয়ে হারিয়ে গেছে চিরদিনের মতো। তবে আদালতের রায়ে নারী জাতির মর্যাদা রক্ষায় তেজোদীপ্ত বীর হিসেবে নুসরাত জাহান রাফিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হয়তো এটাই তার পরিবারের একমাত্র বেঁচে থাকার সান্ত্বনা। নুসরাতদের বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে চোখ বুলাতে দেখলাম অসংখ্য সাদা ফুল ফুটেছে তার কবরে। হয়তো এই সাদা ফুলের প্রতিচ্ছবিই নুসরাতের আত্মার শান্তির নমুনা।