সোজা কথা

পরিমলের শাস্তি সাহস জোগাক মেয়েদের

Looks like you've blocked notifications!
নাজিয়া আফরীন

পরিমল জয়ধর। পেশায় শিক্ষক, তাও আবার রাজধানীর স্বনামধন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো একটি স্কুলের।গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার লাটেংগা গ্রামের পরিমল ২০১০ সালে ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখায় বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১১ সালের ২৮ মে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন এই শিক্ষক। এখানেই শেষ নয়, মোবাইলফোনে সেই চিত্র ধারণ করেন এই নরপিশাচ। সেই ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আবারও মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন তিনি। কী বীভৎস মানসিকতার একজন মানুষ।

ওই বছরেরই জুলাই মাসে মেয়েটির বাবা থানায় মামলা করেন।গণমাধ্যমের বরাতে সেই সময় সবাই জানতে পারল, যে শিক্ষকের হাতে মা-বাবা পরম যত্নে তাঁর প্রিয় সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তুলে দেন তাঁর কী জঘন্য ও ভয়ঙ্কর রূপ। যদিও পরিমলের মাপকাঠিতে সব শিক্ষককে মাপাটা খুবই অন্যায় হবে। বিশেষ করে গার্লস স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে অভিভাবকদের মনে সন্দেহ আর ভয় দানা বাধাটা খুবই স্বাভাবিক।আর এই ভয় যে খুব একটা অমূলক নয় তার প্রমাণ মেলে এই ঘটনার পর পরই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যখন খবর আসতে লাগল বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের হাতে শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা।

আসলে সমাজের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে নেমেছে তা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। এর বীজ কিন্তু আরো গভীরে। কারণ, এই পরিমল জয়ধর নামধারী শিক্ষক যোগ্যতাবলে শিক্ষক হননি। তিনি লবিংয়ের মাধ্যমে এই পদ আদায় করেছেন। যে যোগ্যতা নয়, একে তাকে ধরে শিক্ষকতার মতো একটি পেশায় আসতে পারে, তার কাছ থেকে নীতিবোধ, মূল্যবোধ এসব কিছু আশা করাটাই তো বোকামি।এই অসৎ মানুষ এসব শব্দের মর্মার্থ বুঝবেন কী করে?

পরিমল জয়ধরের মামলার রায় হয়েছে, যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে তাঁর। এই দীর্ঘ চারবছরে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বারবার এই নরপিশাচের মামলার বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিয়েছি, মনে আশঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত এই বাজে লোকটি কি ছাড় পেয়ে যাবেন? দেরীতে হলেও পরিমল সাজা পেলেন। মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল এ বিষয়ে ভালো একটি কথা বলেছেন, তিনি বলেন, পরিমল জয়ধরের বিচার হয়েছে, দেরীতে হলেও তুলনামূলক অনেক কম সময়ে হয়েছে। তবে এই মামলার রায় সমাজের সব শ্রেণীর মেয়েদের জন্য একটি বার্তা- অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করতে হয় না, বরং সঠিকভাবে সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারলে অন্যায়কারী শাস্তি পাবেই।

পরিমল শাস্তি পেয়েছেন কারণ এই বিষয় নিয়ে লজ্জায় মেয়ের মুখ বন্ধ না করে রেখে, মা-বাবা প্রতিবাদ করেছেন, মামলা করেছেন থানায় গিয়ে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেও ধন্যবাদ দিতে হয়, এই মেয়ের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পরিমলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই বছরই, এবং তাঁকে শাস্তি পর্যন্ত দিয়েছে। এখানে মিডিয়াও অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে পরিমল ইস্যুতে সোচ্চার হয়ে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। কিন্তু আমার দুঃখ একটাই, আরো কত মেয়ে যে কত পরিমলের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে তাদের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার থেকেই মেয়েটিকে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়, সম্মানের ভয়ে। তাদের ভয়ও অমূলক নয়, কারণ সমাজ দোষীকে দেখে না, নির্যাতিত মেয়েটির দিকেই আঙুল তোলে। ফলে সাহস করে একবার যদিওবা প্রতিবাদ করে, পরক্ষণেই সমাজের নিষ্ঠুরতায় মেয়েটির সব সাহস, সব আশা, স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। মেয়েটি হয়তো আর কখনো মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্নই দেখতে পারে না।

আরো আগে প্রয়োজন পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ— সব জায়গাতেই একটি মেয়ে যেন নির্যাতনের শিকার না হয়, তার জন্য মেয়েটির মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। কেউ বাজে কথা বললে কিংবা কোনো ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করলে সেটা বোঝার মতো জ্ঞান মেয়েটিকে দিতে হবে পরিবার এবং বিদ্যালয় থেকেই। মেয়েরা যেন মা-বাবা এবং শিক্ষকদের কাছে নির্ভয়ে, বিনাদ্বিধায় যেকোনো কথা বলতে পারে।

পরিমল জয়ধরের যাবজ্জীবন শাস্তি যেন নির্যাতিত মেয়েগুলোকে সাহস দেয়, তোমরা এগিয়ে আস, তুচ্ছ করো মিথ্যা দুর্নামের লজ্জা। তোমাদের পাশে আমরা সবাই আছি। এই সমাজে পরিমলদের কোনো জায়গা নেই।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।