আন্তর্জাতিক
শুধু ধনী মুসলমানদের ভালোবাসেন ট্রাম্প
(দ্বীন ওবেয়েদাল্লাহ একজন মার্কিন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান। দ্বীনের বাবা একজন ফিলিস্তিনি এবং মা ইতালিয়ান হলেও জন্মসূত্রে দ্বীন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিউজার্সিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আরব-আমেরিকান কমেডিয়ানদের মধ্যে দ্বীন এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে তাঁর এই লেখা যুক্তরাষ্ট্রের ডেইলি বিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয় গত ৭ ডিসেম্বর। সেখান থেকেই লেখাটি ভাষান্তর করা হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। সম্প্রতি বর্ণবাদী বক্তব্য, বিশেষ করে মুসলমানবিরোধী বক্তব্যের জন্য তিনি সমালোচিত হচ্ছেন। )
ট্রাম্পের মুসলমান বন্ধুদের বেশিরভাগই উপসাগরীয় অঞ্চলের এবং তাদের কোটি কোটি টাকা আছে। এর থেকে কিছু টাকা তারা ট্রাম্পকে পাঠান। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যটা কী? ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবশ্যই মুসলমানদের বিষয়ে কিছু ইস্যু আছে। তাঁর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশাধিকার বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া উচিত, যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ঘটনার মূল সূত্র আবিষ্কার করতে না পারে।’
এর আগে ট্রাম্প মার্কিন মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক স্বাধীনতা এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার কথা বলেছিলেন। আর সেটা হলে কোনো রকম ওয়ারেন্ট ছাড়াই যেকোনো সময় চাইলেই মুসলমানদের বাড়িঘরে তল্লাশি করা বা রাস্তায় থামিয়ে তাদের তল্লাশি করার সুযোগ তৈরি হতো। ৯/১১-এর কথা টেনে তিনি বলেন, বিশ্বের সব মুসলমান দিন দিন বন্য হয়ে উঠছে।
তবে এক ধরনের মুসলমানদের ট্রাম্প সত্যি ভালোবাসেন। যাঁরা তাঁকে প্রচুর পয়সা দেন। ব্যাপারটা হচ্ছে যদি কোনো মুসলমান ট্রাম্পকে প্রচুর টাকার লোভ দেখায় তাহলে মুসলমানদের নিয়ে যেসব কথা তিনি সাধারণত বলে থাকেন সেগুলো বেমালুম ভুলে যাবেন। যখন নিজের ব্যক্তিগত বিমানে করে টাকা আনতে ট্রাম্প উপসাগরীয় অঞ্চলে যান তখন বিমানের জানালা দিয়ে ওসব মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব ছুড়ে ফেলে দেন।
ট্রাম্পের ভালোবাসার উদাহরণ দিচ্ছি। তিনি হুসেইন সাজওয়ানিকে ভালোবাসেন। সাজওয়ানি হচ্ছেন দুবাইয়ের বিলাসবহুল এবং অভিজাত আবাসন প্রতিষ্ঠান দামাক প্রপার্টিজের প্রধান ব্যক্তি। সাজওয়ানিকে ট্রাম্প একজন ‘ভালো বন্ধু’ এবং ‘মহৎ মানুষ’ বলে অভিহিত করেছেন।
২০১৪ সালের মে মাসে মুসলিম বন্ধুদের সাথে দেখা করতে দুবাইয়ে উড়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। কারণ তাঁর বন্ধুরা তাঁকে ডেকেছিলেন উপসাগরীয় দেশটিতে বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করতে। সেই আবাসন প্রকল্প কত বড় এবং এতে কী পরিমাণ অর্থ লগ্নি আছে সে প্রসঙ্গে আসছি।
৬০ লাখ বর্গফুটের ওই এলাকায় ১০৪টি ভিলা এবং ম্যানশন তৈরি করা হবে। আর এসব ভিলা এবং ম্যানশনের দাম শুরু হবে ১০ লাখ ডলার দিয়ে আর সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য এক কোটি ডলার পর্যন্ত। সেই প্রকল্পে ‘ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড গলফ ক্লাব’ নামের একটি সুবিশাল গলফ ক্লাব রয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, ‘উপসাগরীয় অঞ্চলের যেকোনো ক্লাবের তুলনায় তাঁর ক্লাবটি হবে আরো বড়, ভালো এবং শক্তিশালী।’
সাজওয়ানি কীভাবে তাহলে ট্রাম্পের মতো একজন মুসলমান বিদ্বেষীর কাছে ‘মহৎ মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন? এটা বোঝা খুবই সহজ। সাজওয়ানি যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন ট্রাম্পের কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। দুবাইয়ের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে সাজওয়ানি বলেছেন, ‘আমরা ট্রাম্পকে আমাদের সাথে রাখতে চাই, এ নিয়ে আমাদের সাথে চুক্তিও করেছেন ট্রাম্প।’
তবে ট্রাম্পকে ঠিক কত ডলার দিয়ে তাঁরা কিনেছেন সেটা বলতে চাননি সাজওয়ানি। সেটা যে বড় অঙ্কেই তা বলা বাহুল্য। কারণ ট্রাম্পের নামে তৈরি গলফ ক্লাবটাই নাকি ওই আবাসন প্রকল্পের কেন্দ্রস্থল। ট্রাম্পের নামে তৈরি ওই ক্লাবে থাকবে বিলাসবহুল স্পা, রেস্টুরেন্ট ও স্টোর।
মাত্র এক মাস আগেই ‘ট্রাম্প প্রাইভেট ম্যানশন্স’-এর বিক্রি শুরু হয়েছে। এসব ভিলার দাম শুরু হয়েছে ১০ লাখ ডলার দিয়ে। বলা হচ্ছে এই ভিলাগুলোই নাকি দুবাইয়ের সবচেয়ে ‘আকর্ষণীয় ঠিকানা’। এসব ভিলা থেকে চোখ রাখলেই প্রথমে চোখে পড়বে ‘ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর গলফ মাঠটা।
ট্রাম্প যখন বলেন ৯/১১ এর ঘটনার পর নিউজার্সিতে হাজার হাজার মুসলমান রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে তার কথার স্বপক্ষে কোনো ভিডিও বা প্রমাণ আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু ট্রাম্পের মুসলমান বন্ধু সাজওয়ানির সাথে তাঁর হাসি ঠাট্টার অনেক প্রমাণ রয়েছে। ২০১৪ সালে দুবাইয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের দুজনকে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা গেছে। সাজওয়ানি এবং দুবাইয়ের খুব প্রশংসাও তখন করেছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প নিশ্চয়ই তাঁর বন্ধু সাজওয়ানির কৃতকর্ম নিয়ে বিব্রত বোধ করেন না। কারণ ২০১১ সালে মিসরের একটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন সাজওয়ানি। মিসরীয় সরকারের একটি জমিতে আবাসন প্রকল্প চালুর জন্য তখনকার এক মিসরীয় মন্ত্রীকে বেশ ভালো ঘুষ দিয়েছিলেন সাজওয়ানি।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাজওয়ানির অনুপস্থিতিতে মিসরীয় আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন। আর যে মন্ত্রী সাজওয়ানির কাছে সরকারি জমি বিক্রি করেছিলেন, জনগণের সম্পত্তি আত্মসাতের শাস্তিস্বরূপ তাঁকে জেলে দেওয়া হয়। অবশ্য ২০১৩ সালে মিসরে আরো ‘নমনীয়’ সরকার এলে সাজওয়ানি এবং সেই মন্ত্রীর সাজার বিষয়টি ‘সমঝোতা’ হয়ে যায়।
ট্রাম্পের ব্যবসায়িক অংশীদারের অপরাধ বৃত্তান্ত পাশে সরিয়ে রাখা যাক। ট্রাম্পের নামে যে আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছে দুবাইয়ে সেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ নিয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। দুবাইয়ে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ কতটা অমানবিক হতে পারে সে বিষয়ে অনেকেরই ধারণা আছে। ৩৭ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রায় শ্রমিকদের প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না।
এ বিষয়ে ২০১৪ সালে প্রকল্পটির উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘মিস্টার ট্রাম্প, আপনি কি জানেন, আপনার প্রকল্পে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাঁরা মাসে ২০০ ডলারেরও কম পারিশ্রমিক পান? আপনি কি এতে সন্তুষ্ট?’
এমন প্রশ্নে তখন সেই কক্ষে থাকা অনেকেই বিব্রত হয়েছিলেন। ট্রাম্প সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। পরে ওই প্রকল্পের জনসংযোগ কর্মকর্তা তাঁর হয়ে সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রশ্নটা যথাযথ হয়নি।’
তবে শুধু দুবাইয়ের ধনী মুসলমানরাই ট্রাম্পের বন্ধু তালিকায় নেই। ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠান আবুধাবি, কাতার এবং সৌদি আরবে আরো প্রকল্প করার সুযোগ খুঁজছে। মুসলমান সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে ট্রাম্প কঠোর বিরোধিতা করলেও সৌদি আরব এবং কাতারে তিনি বন্ধু খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যাঁদের সাথে ব্যবসা করা যায়।
মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি উপসাগরীয় দেশগুলোর ধনী মুসলমানদের সাথে ট্রাম্পের কি সখ্যতা। রিপাবলিকান বা সাংবাদিকরা মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের ব্যবসা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চান? ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সহযোগীরা যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করেননি সেটা কি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন?
অন্তত তারা এটুকু তো জানতে চাইবেন, ট্রাম্পের মুসলমান বন্ধুরা কি ৯/১১-এর পর উল্লাস করেছিলেন কি না? আর ট্রাম্প যে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করতে চান, সে ক্ষেত্রে তাঁর ধনী বন্ধুরাও কি যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবেন না?
হয়তো এতে তাঁদের কিছু যায় আসে না। ট্রাম্পের মতো সেলসম্যানের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে মানিয়ে নেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। টাকার জন্য মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব যেমন তিনি করেন, তেমনি ভোটের জন্য আমেরিকানদের কাছে মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারণা চালাতেও তাঁর সমস্যা হয় না। সেলসম্যানের কাজ তো এটাই, ক্রেতা যা শুনতে চান তাঁকে সেটাই বলা।