বিজয়ের এই দিনে

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের আত্মদান

Looks like you've blocked notifications!

আজকের এই দিনে অসীম বীরত্বের সঙ্গে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত মোহাম্মদ রুহুল আমিন। সংশপ্তকের বাস্তব প্রতীক এ যোদ্ধা রূপসার কোলে শায়িত হন চিরদিনের জন্য। রণাঙ্গনের ভুল বোঝাবুঝির ফলে চিরদিনের জন্য চলে যান না-ফেরার দেশে।

এই দিন যৌথ বাহিনীর বিমান হামলায় বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা রেডিও কেন্দ্র। পাশাপাশি বিধ্বস্ত হয়ে যায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দর।

দিবাগত রাতে নিজ বাসা থেকে অপহৃত হন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআই সংবাদ সংস্থার প্রধান সংবাদদাতা সৈয়দ নাজমুল হক। তাঁদের আর পাওয়া যায়নি।

এদিন ঢাকার পথে শত্রুপক্ষের যত স্টিমার ও গানবোট এগোনোর চেষ্টা করেছিল, তার প্রায় সবগুলোই পরাস্ত হয়ে সলিল সমাধিতে পৌঁছে। কারণ, মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত ছিল।

অন্যদিকে, যৌথ বাহিনী তাদের ট্যাঙ্কগুলো নিয়ে বিশেষ কৌশলে ঠিকই নদী পার হয়েছিল। ৫৭ নম্বর ডিভিশন গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিল। ভোররাত থেকে ভৈরববাজারের তিন-চার মাইল দক্ষিণে হেলিকপ্টার করে নামানো হলো ৫৭ নম্বর ডিভিশনের সৈন্যদের।

সারা দিন ধরে তাদের মেঘনা অতিক্রমের অভিযান চলে। কৌশল হিসেবে প্রথম বাহিনীটা নেমেই ঘাঁটি গেড়ে বসে।

কারণ, এর কিছুটা উত্তরে ভৈরববাজারের কাছেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক বড় মজুদ ঘাঁটি ছিল। তারা ব্রিজটার একটা অংশ ভেঙে দিয়ে নদীর পশ্চিম দিকটায় ওত পেতে বসে ছিল।

সূর্য উঠতেই হানাদারদের চোখে পড়ে হেলিকপ্টার। নদী পার হচ্ছে। কিন্তু তারা ঘাঁটি ছেড়ে এগোতে সাহস পায়নি। বোধ হয় তারা ভেবেছিল, এটা মুক্তিবাহিনীর একটা ফন্দি মাত্র। যদি তারা ঘাঁটি ছেড়ে ওদিকে এগোয়, তাহলে আশুগঞ্জ থেকে যৌথ বাহিনীর মূল মিত্রবাহিনীটা ভৈরবাজার হয়ে ঢাকার রাস্তা ধরে ফেলবে।

হেলিকপ্টারে করে কিছু সৈন্য নদী পার হলো। আর বাকিরা লঞ্চ-স্টিমার ও নৌকাতে করে। কিন্তু ট্যাঙ্কগুলো তো আধাঘণ্টার বেশি সাঁতরাতে পারবে না, তাহলে? দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আধাঘণ্টা পর যখন ট্যাঙ্কগুলো গরম হয়ে যাবে, তখন নৌকা দিয়ে টেনেই এদের কূলে নেওয়া হবে। যে কথা সেই কাজ। মুক্তিকামী সাধারণ জনগণ তাদের দেশি নৌকা দিয়ে যৌথ বাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য করল।

এদিন বিবিসি তাদের এক নিউজে জেনারেল নিয়াজি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে সংবাদ ফাঁস করে। তবে নিয়াজি এ তথ্য সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা, আমি তাঁদের জানাতে চাই, আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাব না।’

পূর্বাঞ্চলের পর আজকের এই দিনে সর্বাত্মক সাফল্যে পৌঁছে মিত্রবাহিনী। তাঁরা বিমান আক্রমণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল করে দিতে সক্ষম হয়।

মিত্রবাহিনীর বিমান হামলার জেরে চীন পাকিস্তানের পক্ষে সিকিম-ভুটান সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করে। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের নির্দেশে সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালিতে অবস্থান নেয়।

যৌথ বাহিনীর অভিযানে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরে শত্রু বাহিনী পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শত্রুমুক্ত হয় রংপুর ও দিনাজপুর জেলা।

এই দিন রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর চেষ্টা করে। তবে শহরের অদূরে তারা যৌথ বাহিনীর কবলে পড়ে। উভয় গ্রুপের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে প্রায় দেড় হাজার হানাদার সেনা নিহত হয়। আর বাকিরা আত্মসমর্পণ করে।

একাত্তরের এদিন ময়মনসিংহ শহরে হানাদার বাহিনী ডাকবাংলো, কোওয়াটখালী, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালীবাড়ি ও সাহেব আলী রোড এলাকায় বহু বেসামরিক লোককে হত্যা করে।

ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লির বিশাল জনসভার ভাষণে যুদ্ধবিরতি-সংক্রান্ত জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারত এ আহ্বান গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে।' একই ভাষণে তিনি আরো বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্ভব হবে, যখন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে।’

এদিন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন ও রণকৌশল-সংক্রান্ত যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারতের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

এদিন জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে এক আলোচনায় বসেন গভর্নর মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব মুজাফফর হোসেন। তাঁরা ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘের প্রতিনিধির পল মার্ক হেনরির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে তাঁরা ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘অস্ত্রসংবরণ’ কথাটি ব্যবহার করে।

পাশাপাশি তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্ররোচণা ছিল এর উল্টো। তাঁর দম্ভের মূলে ছিল সপ্তম নৌবহর।

আজকের এই দিনেই শত্রুমুক্ত হয় দ্বীপ জেলা ভোলা।