অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। হরতাল-অবরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর, হত্যা, গুম, খুন, মারামারি, কাটাকাটি, হিংসা, বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে দেশ। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কাছে দেশ আজ অবরুদ্ধ; মানুষ আজ জিম্ম। উদ্ভট পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর দুর্বল নেতৃত্ব নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতির কাছে ক্ষমতার মসনদ নিয়ে আজ কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু আর গণতন্ত্রের শত্রু পতিত স্বৈরাচার আজ রাজনীতির নিয়ামক। প্রহসনের নির্বাচন আর ধ্বংসাত্মক অন্দোলন এই দুইয়ের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে মানুষ আজ মরছে; ঘরবাড়ি পুড়ছে, ধ্বংসের দ্ধারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে দেশ। দেশের মানুষের সামনে আজ নেই কোনো আশার আলো, নেই ভরসার কোনো আলোকবর্তিকা। মসনদের অন্ধ মোহ, লোভ লালসা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দেশ ও জাতি আজ বিভক্ত।
বাংলাদেশ নামক এ দেশটির জন্ম হয়েছিল এক সাগর রক্ত এবং ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। দীর্ঘ সংগ্রাম আর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই যে গ্রামে শহীদ মিনার নেই, নেই শহীদের কবর কিংবা বীরঙ্গনার আর্তনাদ। বাংলাদেশের এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের চিহৃ নেই। সৌভাগ্য এ দেশের মানুষ ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, লাওস, কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মতো সুদীর্ঘ কোনো যুদ্ধ তাদের করতে হয়নি। ভাগ্যবান বাঙালি জাতি সে যুদ্ধে পেয়েছিল এক অসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সূদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্য। যার ফলে আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ খালি হাতে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ- বাংলাদেশ।
যে রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে রয়েছে বাঙালি জাতিসত্ত্বার এক সুদীর্ঘ অন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। রয়েছে সৎ, ত্যাগী, আদর্শবান, যোগ্য নেতৃত্বে এক সফল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাস। তেমনি রয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক বাঙালি নামধারী কুলাঙ্গারের পরাজয়ের গ্লানির ইতিহাস। বিজয়ী জাতি স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের ক্ষমা করে দিলেও, তারা কিন্তু ভুল স্বীকার করে কখনো ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। আর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বে বিজয়ীরা যখন লিপ্ত; যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াতে ব্যস্ত। আতুড় ঘরে তাকে নিঃশেষ করে দিতে দেশি-বিদেশি পরাজিত শকুনরা তখন থেকেই চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে। চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকিয়ে তারা বিজয়ী যোদ্ধাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে তাদের পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ঘাটিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারা আঘাত হানে। একই বছর ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয় স্বাধীনতার মহান স্থপতিদের। কাটা দিয়ে কাটা তোলার নীতিতে তারা জাতির জনক, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, স্বাধীনতার ঘোষক আর বীর যোদ্ধাদের একে একে নিধন করে। সর্বশেষ তারা দুই জাতীয় বীরের উত্তরাধিকারদের মাঝে মসনদের অন্ধ মোহ, তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলে। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, বিদ্ধেষ আর প্রতিহিংসার আগুন জালিয়ে দেয়। যে আগুনে আজ দাউ দাউ করে জ্বলছে বাংলাদেশ।
২.
বাংলাদেশ পলি মাটির দেশ, বাংলাদেশ জোয়ার-ভাটার দেশ। এ দেশের মানুষ বড় সহজ-সরল। এ দেশের মাটি বড় উর্বর। বর্ষায় গলে গিয়ে এ মাটি যেমন নরম কাদায় পরিণত হয়, আবার গ্রীষ্মের তাপদাহে শক্ত-কঠিন হয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এ দেশের নদী-সমুদ্রের জল, জোয়ারে জেগে উঠে যেমন দুই কূল প্লাবিত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবার ভাটার টানে শুকিয়ে মরে কাঠ হয়ে যায়। বাংলার অদ্ভুত এই মাটি-প্রকৃতি আর মানুষের কারণেই কোনো অর্জনকেই বাঙালি জাতি বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না। আর তাই একাত্তরের স্বাধীনতা পঁচাত্তরেই পথ হারায়। সামরিক স্বৈরাচার আর আধিপত্যবাদী শক্তি আবার দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। নব্বইয়ে আবার জেগে উঠে বাঙালি জাতি। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু এবারও ছন্দ পতন ঘটে। এক অদ্ভুত, উদ্ভট পরিবারতন্ত্রের কাছে গণতন্ত্র আবার হারিয়ে যায়। একাত্তরের পরাজিত রাজাকার আর নব্বইয়ের পরাজিত সামরিক স্বৈরাচার এবার চেপে বসে উত্তরাধিকারের দাবিতে রাজনীতিতে পুনর্বাসিতদের ঘাড়ে। তারা এক পুতুল খেলা শুরু করেছে। একূল থেকে ওকূলে চেপে দুধ-কলা খেয়ে তারা হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে উঠে। সীমাহীন লোভ-লালসার কারণে তারা জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে।
বাংলাদেশের সামনে আজ তাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত্ব আর গণতন্ত্র আজ হুমকির সম্মুখীন। বাঙালি জাতিসত্ত্বার অভ্যুয়দ্বয়ের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐক্যবদ্ধ শক্তি আজ খণ্ডিত-বিভাজিত। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের মাধ্যমে একে অন্যকে নিশ্চিহৃ করে ফেলার জন্য পরস্পর আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। হত্যা, খুন, গুম, আর প্রতিহিংসার আগুনে আজ দাউ দাউ করে জ্বলছে বাংলাদেশ। এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে আজ দ্রুত ধাবমান বাংলাদেশ। সমাজ-সভ্যতা ও দেশ বাঁচাতে আজ তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইস্পাত কঠিন সুদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্য। যে ঐক্যের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবে নতুন প্রজন্মের তরুণরা। আত্মদ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে তাদের মতো করে দেশটাকে আজ তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে। যে তরুণ দুর্বৃত্তায়িত-দেউলিয়া রাজনীতির শিকারে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আজ গাড়ি ভাঙছে, বাড়িতে আগুন দিচ্ছে, মানুষের দিকে ককটেল-পেট্রলবোমা ছুড়ে মারছে, তাকে থামতে হবে, থামাতে হবে। যে তরুণ দুর্বল-দেউলিয়া নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তি করে যৌবনের শক্তিকে বিপথে পরিচালিত করছে তাকেও থামতে হবে, থামাতে হবে। জাতীয় আদর্শের প্রতীক যৌবনের শক্তিকে দেশ ও জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করে দিতে হবে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি পরিহার করে, সমাজ-সভ্যতা ও দেশ বাঁচাতে সব দেশপ্রেমিক নাগরিককে একাত্তর আর নব্বইয়ের চেতনায় আবারও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শেখ আখতার উল ইসলাম : আইনজীবী, সভাপতি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি।