মেট্রোরেল বিতর্ক

মেট্রোরেল শাহবাগ-মৎস্য ভবন দিয়ে যাক

Looks like you've blocked notifications!

মেট্রোরেল ইস্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সরকারকে পরস্পরবিরোধী করে দেওয়ার একধরনের প্রবণতা চোখে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের চিরাচরিত রাজনৈতিক চর্চার সাপেক্ষে এই ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের সৃষ্টি হয়ে গেছে। এর ফলে, এই ঘটনায় এমন একটি দৃশ্যকল্পও সৃষ্টি হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন মেট্রোরেল চায়ই না! তবে আদতে বিষয়টি তেমন নয় মোটেও। শিক্ষার্থীদের দাবি, মেট্রোরেলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে না গিয়ে একটু পাশ দিকে যাক। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হলেও ক্যাম্পাস এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছে মায়ের কোলের মতোই। তাই একে চিরে কোনোকিছু এগিয়ে যাক, তেমনটা একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন। এ বিষয়ে অবশ্য কেবল আবেগ নয়, যথাযথ যুক্তিও আমার তথা শিক্ষার্থীদের রয়েছে। এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটি গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক সমালোচনা হওয়া প্রয়োজন।

লেখার শুরুতেই দুটো জিনিস পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।

ক. আমি অথবা সমস্ত শিক্ষার্থীই মেট্রোরেলের পক্ষে। ঢাকা শহরের জন্য অবশ্যই মেট্রোরেল প্রয়োজন।

আমার অনুরোধের জায়গা হলো মেট্রোরেল ক্যাম্পাসের বুক চিরে না গিয়ে পাশ দিয়ে যাক।

খ. খণ্ডিত বক্তব্য প্রচার না করা ভালো। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হলো তাঁর কাছে পুরো বার্তাটি পৌঁছায়নি। উনি শুধু শিক্ষার পরিবেশ এবং শব্দদূষণ নিয়ে কথা বলেছেন। একবারও শুনলাম না মঙ্গলযাত্রা, রাজু, ক্যাম্পাসের ল্যান্ডস্কেপ, ঢাবির আর্কিওলজিকাল স্থাপনাগুলোর কী হবে? তাঁর কাছে পুরো বার্তা যাওয়া খুব প্রয়োজন। শব্দ, শিক্ষার পরিবেশ, কম্পনের চেয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির মূল জায়গাই এটা। বিষয়টি নিয়ে যাঁরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সমালোচনা করছেন, তাঁরা পুরো ব্যাপারটিরই একটি গঠনমূলক সমালোচনা করবেন বলে আশা রাখি।

মেট্রোরেল ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে নিয়ে যেতে অনুরোধ করার মূল কারণ ক্যাম্পাসের ল্যান্ডস্কেপ। আমাদের ট্রেডমার্ক সংস্কৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রা, বইমেলা, ক্যাম্পাস এলাকার পুরাকীর্তি ও পুরোনো স্থাপনা আর টিএসসি সন্নিহিত এলাকার সাংস্কৃতিকবলয়। আরো রয়েছে কার্জন হল, দোয়েল চত্বর ঢাকা গেটসহ বেশ কিছু পুরাকীর্তি। মেট্রোরেলের জন্য যে নকশা করা হয়েছে তা এই বিষয়গুলোর অস্তিত্ব এবং চিরাচরিত প্রতিকৃতিকে বিপন্ন করে তোলে। এই বিষয়গুলোকে কখনোই অবহেলা করা সম্ভব নয়, কারণ এগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যেরও অংশ।

১. প্রথমেই আসি ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে

এ ধরনের প্রতিটি প্রকল্পে অবশ্যেই ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে আমলে নিতে হয়, আর্কিওলজিকাল সার্ভে করতে হয়। মেট্রোরেলের রুটে সংলগ্ন এলাকায় যে পুরাকীর্তি অথবা ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে, সেগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করা আবশ্যক, একান্ত আবশ্যক। মেট্রোরেলেরও করা হয়েছিল। মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য এই সার্ভেটি করেছিল AECL নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এই জরিপের নেতৃত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এইচ হক। গবেষণায় কাজ করেছিলেন ১২ জন।

উনি গত বছরের (২০১৫) মাঝামাঝিতে এই হিস্টোরিকাল ইমপরট্যান্স বা আর্কিওলজিকাল সার্ভের খসড়া রিপোর্ট দিয়েছিলেন যেখানকার উপসংহারে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে তাঁরা এই সার্ভেতে ঢাকা শহরের বুদ্ধিজীবী, স্থপতি, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকদের ইন্টারভিউ নিয়েছেন এবং তারা পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল রেকর্ড, প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় টিএসসি-দোয়েল চত্বর দিয়ে রুট না নিয়ে শাহবাগ-মৎস্য ভবন দিয়ে নেওয়া হোক। ওখানে সংসদ ভবনকেও বাঁচানোর সুপারিশ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে রুট না নেওয়ার ব্যাপারে সেখানে লাইনগুলো হুবহু এরকম ছিলো, “… to trail towards Ramna and Matshya Bhaban area from Shahbag instead of conducting line towards TSC area to safeguard the area and its adjacent archaeological, historical and national record.”

সুতরাং নেহাত আবেগ নিয়ে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করা হচ্ছে; এমন ভাবলে একেবারে ভুল! লক্ষ করুন, প্রকল্পেরই নিজস্ব আর্কিওলজিকাল সার্ভেতে বলা হয়েছে, উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি প্রতিটি বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নির্দিষ্ট দিক ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে মেট্রোরেলের কারণে বিভিন্ন স্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ। এ নিয়ে গত বছরের (২০১৫) মে মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরাসরি প্রতিবেদনও করা হয়েছে।

এবার মেট্রোরেলের জন্য যে প্রকল্পের যে অফিশিয়াল EIA বা (Environmental Impact Assesment) রিপোর্ট আছে খোদ সেখান থেকে দুটো ছবি দেই। এই ছবিতেই লাল লাল যে বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন সেটা হলো রুটের আশপাশের আর্কিওলজিকাল স্থাপনা। খেয়াল করে দেখুন, পুরো রুট জুড়ে গুটিকয়েক বিন্দু। আর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবশিষ্ট সব বিন্দু বা ঐতিহাসিক স্থাপনা বা পুরাকীর্তিগুলো। মোট লাল বিন্দুগুলোর ৯০ শতাংশই চারুকলা, টিএসসি, দোয়েল চত্বরকেন্দ্রিক।

প্রতিবেদনে যে গোল চিহ্ন দেওয়া রয়েছে, সেটি খোদ প্রকল্পেরই দেওয়া। প্রকল্প থেকেই এই জায়গাগুলো বিশেষভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশটা একটু ‘জুম’ করে এখানে দেওয়া হয়েছে।

২. ক্যাম্পাসের ল্যান্ডস্কেপ :

যাঁরা বলছেন এটা সোহরাওয়ারদী উদ্যানের পাশ দিয়ে যাবে, তাঁরা সম্ভবত না জেনে বলছেন। মেট্রোরেল আক্ষরিক অর্থে শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বরের রাস্তার মাঝ বরাবর দিয়ে যাবে। প্রকল্পের অফিশিয়াল ইউটিউব ভিডিও দেখুন, তাহলেই এর সপক্ষে প্রমাণ পাবেন। প্রকল্পের ইআইএ রিপোর্টেও (বাংলা, পৃষ্ঠা ৭) উল্লেখ করা রয়েছে, প্রধান সড়কের মাঝ বরাবর যাবে। প্রকল্পের অফিশিয়াল ভিডিও ডকুমেন্ট থেকে দুটি স্ক্রিনশট দেওয়া হলো। প্রথমটি দোয়েল চত্বরের, দ্বিতীয়টি রাজু ভাস্কর্যের।

এবার টিএসসি/রাজুর অংশটা দেখা যাক :

ভিডিওর লিংক

এবার আসি ক্যাম্পাসের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে

ওপরের ছবিটি হলো মেট্রোরেলের রুট। মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে মোট ১৬টি স্টেশন হবে। চিত্রে সাদা মার্ক করা অংশগুলো একেকটি স্টেশন। এবং প্রতিটি স্টেশনের দৈর্ঘ্য ১৮০ মিটার এবং প্রস্থ ২০ থেকে ২৬ মিটার। টিএসসিসংলগ্ন রাস্তার ঠিক মাঝদিয়ে যাওয়া রুটে টিএসসির কাছাকাছিই থাকছে এরকম দৈর্ঘ্য-প্রস্থের একটি স্টেশন। এই রুটে পাশাপাশি দুটি ট্রেন চলতে পারবে। সুতরাং রাজু ভাস্কর্য এবং টিএসসি অবশ্যই তার ল্যান্ডস্কেপ হারাচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে। প্রকল্পের থ্রিডি মডেলে বিভিন্ন রুটের থ্রিডি ছবি দেওয়া রয়েছে কিন্তু টিএসসিরটি নেই। ছবিতে রয়েছে দোয়েল চত্বরেরটি।

মেট্রোতে ল্যান্ডস্কেপ হারাচ্ছে তিন নেতার মাজার। ঢেকে যাচ্ছে এটি। এখানে আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কবরও রয়েছে।

প্রকল্পের থ্রিডি ভিউয়ের অফিশিয়াল ভিডিও লিংক

সম্ভবত ইচ্ছে করেই (?) এই ভিডিওতে রাজু ভাস্কর্যর পেছন দিয়ে গেলে কেমন দেখা যাবে, সেটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারণ রাজু ভাস্কর্যের মূল সৌন্দর্য হলো অন্যায়ের প্রতিবাদে একদল তরুণ-তরুণীর মুঠিবদ্ধ হাত আর সেটার পেছনের অবারিত মুক্ত খোলা আকাশ যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত চিন্তারই প্রতীক।

এবার আসি তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ, শব্দ, কম্পন ইত্যাদি বিষয়ে

প্রকল্পের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টের ১২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় স্পষ্ট করে লেখা আছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের সময় বায়ুদূষণ হবে এবং এটা সম্পূর্ণ আনঅ্যাভয়ডেবল অর্থাৎ কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না। রিপোর্টের স্ক্রিনশট

রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, নির্মাণকাজের সময় শব্দদূষণও হবে। আর ট্রেন নিঃশব্দ হবে না। মেট্রো চলাচলে কিছুটা শব্দ হবেই। তবে শব্দ সীমিত করার জন্য এমএসএস নামক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, এমএসএস প্রযুক্তি দিয়ে শব্দ কমানো হবে। কিন্তু তার পরেও নির্মাণকাজের চার বছরের শব্দ তো আর সীমিত করা যাচ্ছে না। এই ক্যাম্পাসের মধ্যে শাহবাগ থেকে শুরু করে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রয়েছে তিনটি লাইব্রেরি। এর মধ্যে দুটি হছে দেশের সবচেয়ে বড় দুটি লাইব্রেরি। রুটটা শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন হয়ে গেলে এই প্রসববেদনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ছিল।

আবারও রিপোর্ট থেকে শব্দ সংক্রান্ত স্ক্রিনশট

ভাইব্রেশন নিয়ে রিপোর্টে বলা যা হয়েছে

নির্মাণকাজের সময় তেমন ভাইব্রেশন বা কম্পন না থাকলেও ট্রেন চলাচলের সময় বেশ ভাইব্রেশন হবে (রিপোর্টে যেটাকে বলা হচ্ছে সিগনিফিকেন্ট)। প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই কম্পনকেও সীমিত বা সহনীয় করার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে পুরো রুটের মধ্যে দোয়েল চত্বরের পাশে মোগল আমলের স্থাপত্য ঢাকা গেটের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কম্পনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে এটার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। অর্থাৎ একটা চিরস্থায়ী কম্পন আর্কিওলজিকালি গুরুত্বপূর্ণ এই ক্যাম্পাসের স্থায়ী সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই কয়েক মিনিট পরপর যেতে থাকা মেট্রোরেলের সীমিত কম্পনে আজ থেকে ১০-২০ বছর পর কার্জন হল, ঢাকা গেটের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর কী প্রভাব হবে অথবা বিশেষ ব্যবস্থায় এটি কতটুকু/কতদিন টিকে থাকবে সেটি বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে এলাকায় এতগুলো পুরোনো এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা তার আশপাশ দিয়ে এই ঝুঁকিটা আমরা নেব কি না?

রিপোর্টের ভাইব্রেশনের ঢাকা গেটের অংশের একটা অংশের স্ক্রিনশট দিচ্ছি :

৪. অংশীদারদের ফিডব্যাক

এই ইআইএ করার সময় পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়ে দুটি পাবলিক কনসালটেশন মিটিং হয়েছে। একটা উত্তরে, আরেকটা দক্ষিণে। প্রকল্পসংলগ্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে যে এদিক দিয়ে মেট্রোরেলের রুটের ব্যাপারে অংশীদারদের মতামত, আপত্তি অথবা প্রশ্নগুলো কী?

উত্তরের মিটিংটি হয়েছে মেট্রোরেলের উত্তর পয়েন্ট দিয়াবাড়ীতে গত বছরের (২০১৫) ২৩ মার্চ এবং দ্বিতীয়টি হয়েছে দক্ষিণ পয়েন্ট শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে ২০১৫-এর ৬ মে-তে।

ইআইএ ডকুমেন্টটিতে তাদের নাম, পেশা এবং মতামতসহ দেওয়া আছে। প্রথমটাতে উপস্থিত ছিলেন ৪০ জন। দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয় শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে যেটাতে নানা শ্রেণি-পেশার ৭০ জন উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে মতামত নেওয়া হয়েছে সাতজনের, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসক, ফুলের দোকানি, সাংবাদিক, স্থপতি, স্থানীয় ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের কোনো মন্তব্য বা মতামত নেই সেখানে। যদিও ওই ৭০ জনের মধ্যে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতির প্রমাণও নাম, পেশাসহ তালিকায় রয়েছে।

৫. ঢাবিকে ঘিরে সাংস্কৃতিকবলয়

বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পাশ দিয়ে মেট্রো রেল গেছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি থেকে উলম্ব হয়ে মেট্রোরেল গেছে, কোনটায় সমান্তরাল, অথবা ইউটিউবে সাউন্ড অব মেট্রো রেল লিখে সার্চ দিয়ে সেটার তুলনামূলক আলোচনা এখানে একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, সেই তুলনা এলে আরো অনেক তুলনা আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ও বিশ্বের বুকে অনন্য এর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম নয়- বরং রাজনৈতিক কারণে। কারণ একাডেমিক র‍্যাংকিংয়ে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে থাকলেও রাজনৈতিক কারণে বিশ্বের বুকে ঢাবি অনন্য ও একমাত্র। কারণ, একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতিকে গঠন করেছে, দিয়েছে ভাষা, পতাকা। হাতে ধরে শিখিয়েছে সংস্কৃতির পাঠ। পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, চারুকলা, ঐতিহাসিক স্থাপনা, পুরাকীর্তিগুলোর একটা আলাদা ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে, রয়েছে অসম্ভব মূল্য। এ জন্য ঢাবিকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত জাদুঘর। আর এসবের সংরক্ষক হিসেবে আওয়ামী লীগকেই তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট মনে হয়েছে আমাকে।

কারণ, আওয়ামী লীগ সেই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক মূল্যের ওপর দিয়েছিলে বিশেষ গুরুত্ব। তখনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই তো মাত্র দুই বছর আগেই আপনি বাংলা একাডেমিতেই বলেছিলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশের রাজধানীতে একটি সাংস্কৃতিকবলয় থাকে।’ আরো বলেছিলেন,  ‘রাজধানীর বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও শিল্পকলা একাডেমি এলাকা নিয়ে এ সাংস্কৃতিকবলয় গড়ে তোলা হবে।’ ইত্তেফাক (তারিখ : ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ২০১০ সালেও গ্রন্থমেলায় আপনি এই সাংস্কৃতিকবলয়ের কথা বলেছেন। বলেছেন এ বছরের আগস্টে তথ্য ভবনের উদ্বোধনকালেও।

১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই এই সাংস্কৃতিকবলয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে সোনার বাংলা সাংস্কৃতিকবলয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকেন্দ্রিক সেই সাংস্কৃতিকবলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই সারা দিন পড়াশোনা করে না। মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত এ জাদুঘরটিতে আড্ডা, বন্ধুত্ব, গান, সংস্কৃতি আর রাজনীতির মাধ্যমে তারা বিকশিত হয়। তাদের এই জায়গাটা করে দেয় টিএসসি, রাজু চত্বর, চারুকলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আরো অনেক সাংস্কৃতিক আয়োজন।

আওয়ামী লীগও সেটা বুঝেছিল সেই ১৯৯৭ সালে। এই কারণে এই সংলগ্ন ও সন্নিহিত এলাকাজুড়ে করা হয়েছিল সাংস্কৃতিকবলয়ের মহাপরিকল্পনা। বলা হয়েছিল এই পরিকল্পনাকে কখনো বিঘ্নিত করা হবে না।

ওপরের পয়েন্টগুলোর কারণে আমার নিজের মাথায়ই কিছু প্রশ্ন এসেছে। এবার আমার প্রশ্নগুলো একেক করে ফেলি :

প্রথম প্রশ্ন : কেন মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে প্রকল্পের নিজস্ব ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা আর্কিওলজিকাল সার্ভের এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া স্থপতি, ঐতিহাসিক, প্রত্মতত্ত্ববিদের সুপারিশ গ্রহণ করা হলো না?

দ্বিতীয় প্রশ্ন : মেট্রোরেল তো সেই উত্তরা থেকে মূল রাস্তার ওপর দিয়েই এসেছে, তাহলে শাহবাগ দিয়ে মৎস্য ভবন হয়ে মূল রাস্তা ধরে মতিঝিল গেলে কী ক্ষতি ছিল? যে রুটের আশপাশ দিয়ে এতগুলো ঐতিহাসিক স্থাপনা সেটার ভেতর দিয়ে রুটটা নেওয়া কি খুবই জরুরি ছিল? 

তৃতীয় প্রশ্ন : কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় স্থাপনাগুলোর ল্যান্ডস্কেপকে গুরুত্ব দেওয়া হলো না?

চতুর্থ প্রশ্ন : জেনেবুঝে আমরা কেন নির্মাণকালীন (প্রায় চার বছর) শব্দ, বায়ুদূষণ এবং নির্মাণ-পরবর্তী স্থায়ী কম্পনের ঝুঁকি টেনে আনছি? কেন মোগল আমলের স্থাপত্য ঢাকা গেট, কার্জন হল, মুসা খাঁ মসজিদের মতো পুরাকীর্তিগুলো নিয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকিটা নিচ্ছি?

পঞ্চম প্রশ্ন : মেট্রোরেল ক্যাম্পাসের বুকে চিরে নিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা দ্রুত ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করতে পারবে। এখানেই জিজ্ঞাসা, শাহবাগ কি ক্যাম্পাস থেকে দূরে? শিক্ষার্থীরা তো সহজেই শাহবাগ স্টেশনে নামতে পারে। এটুকু পথ তো তারা হেঁটে বা রিকশায় যেতে পারে। টিএসসির পাশের প্রস্তাবিত স্টেশন থেকে কলাভবন, বিজনেস ফ্যাকাল্টি অথবা সমাজবিজ্ঞান ভবন যতদূর, শাহবাগ থেকেও প্রায় ততদূর।

ষষ্ঠ প্রশ্ন : ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার একমাত্র পাবলিক কনসালটেশন মিটিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতামত যোগ করা হলো না। কেন?

সপ্তম প্রশ্ন : সরকারের সাংস্কৃতিকবলয়ের মহাপরিকল্পনার ভেতর দিয়ে কেন মেট্রোরেলের বিভেদের রেখা টানা হচ্ছে? স্টেশন করা হচ্ছে?

একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা

আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন নীলক্ষেতসংলগ্ন স্যার এ এফ রহমান হল থেকে টিএসসি পর্যন্ত যে রাস্তা সেটার মাঝে কোনো রোড ডিভাইডার ছিল না। পুরো রাস্তাটাই ছিল অবারিত এবং বিশাল। যেকোনো উৎসবে, বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা ওই বিস্তৃত রাস্তা দিয়ে নেমে আসত ঢলের মতো সমুদ্রগভীর হয়ে। কুখ্যাত মইন ইউ-ফখরুদ্দিন সময়ে ওই রাস্তার মাঝখান দিয়ে সৌন্দর্য তুলে দেওয়া হয় বার্লিন প্রাচীরসম বিশাল রোড ডিভাইডার। ওই দিন এক বড় ভাই আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘আজ থেকে ক্যাম্পাসের আন্দোলনের শক্তি, উদযাপনের শক্তি অর্ধেক হয়ে গেল।’ তখন বুঝিনি, এখন বুঝি।

যাঁরা প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার ইংরেজি ইআইএ রিপোর্টটা পড়তে চান, তাঁরা এই লিংক থেকে পড়তে পারেন : http://goo.gl/oHwV8P

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।