সাইবার নিরাপত্তা

কী থাকছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে?

Looks like you've blocked notifications!
আমীন আল রশীদ

কোনো ব্যক্তি যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মু্ক্তিযুদ্ধের বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাতে মদদ দেয়, তাহলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা তিনি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম বিধান রেখে প্রণয়ন করা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

আইনের যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তার ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা, অশ্লীল এবং যা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাব হেয়প্রতিপন্ন করে; অথবা কেউ যদি স্বেচ্ছায় কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পাঠ করলে বা দেখলে বা শুনলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, তাহলে তিনি অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার সঙ্গে নতুন আইনের এই ১৯ ধারার বেশ মিল রয়েছে। তবে পার্থক্য হলো, ৫৭ ধারার তুলনায় ১৯ ধারায় শাস্তির পরিমাণ কম। ৫৭ ধারায় কেউ অপরাধ করলে তার অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি এটি জামিন অযোগ্য। পক্ষান্তরে নতুন আইনের ১৯ ধারায় কেউ অপরাধ করলেও সেটি জামিনযোগ্য।

নতুন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ধারা রহিত হবে এবং এই ধারাগুলোর অধীনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নতুন এই আইনের অধীনে নেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ এটি এখন কিছুটা আশার কথা যে, ৫৭ ধারার ভয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কিছু লিখতে গিয়ে যেমন তটস্থ থাকেন, ধারাটি রহিত হলে সেই ভয় অনেকটা কাটবে।  

কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থার বিধান থাকছে নতুন আইনে। এর ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোনো কোম্পানি বা কোনা ব্যক্তিকে কাজ করতে বা কাজ থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার উদ্দেশে কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, তাহলে তিনি ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন। আর এই অপরাধে তিনি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

 

নতুন এই আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অসৎ উদ্দেশে ইচ্ছেকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে অন্য কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত ছবি তোলে এবং প্রকাশ করে বা বিকৃত করে বা ধারণ করে তাহলে এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে; যার শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড।

তবে কারো ব্যক্তিগত ফোন কল প্রকাশ করলে সেটি অপরাধ হবে কি না, তা এই আইনে বলা নেই।

ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি ও শিশু পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধেও কঠোর বিধান থাকছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। শিশু পর্নোগ্রাফির অপরাধে অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আলোকে নতুন এ আইনেও একটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া সঙ্গত যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলেও ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনও বহাল থাকবে।

জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনেরও বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। আর এ কর্তৃপক্ষ পরিচালনার জন্য একজন মহাপরিচালক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিচালক, উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।

তা ছাড়া মহাপরিচালকের নিয়ন্ত্রণে এক বা একাধিক ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে; যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল থাকবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির অধীনে বাংলাদেশ সাইবার ইমার্জেন্সি বা ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম নামে একটি প্রধান টিম থাকবে। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য মন্ত্রণালয় বা সেক্টরভিত্তিক একাধিক টিম থাকতে পারবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তার সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়ে জাতীয় ‍গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনেরও বিধান রাখা হয়েছে, যারা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বা নাগরিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত নির্দিষ্ট কিছু কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক বা তথ্য পরিকাঠামোগুলোকে অত্যাবশকীয় তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।

নতুন এ আইনে ‘সন্ত্রাসী সম্পদ’ বলে একটি টার্ম রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে কোনো সম্পদ যা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহৃত হতে পারে বা হয়েছে বা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্র কর্তৃক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত কোনা ব্যক্তি, কোম্পানি বা স্বত্বার সম্পদকে বুঝাবে। এ ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগে যেসব ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা নানা সময়ে ইঙ্গিত করেছেন, সেসব প্রতিষ্ঠানও এ আইনের অধীনে শাস্তির আওতায় আসতে পারে বলে ধারণা করা যায়।

একটি ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি এমন কিছু প্রকাশ করেন যা দেখলে বা শুনলে নাগরিকদের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে, তাহলে এই অপরাধে তাকে সাত বছর কারাদণ্ড অথবা সাত লাখ টাকা জরিমানা অথবা  উভয় দণ্ড দেওয়া হতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সম্প্রতি দুজন সরকারি কর্মকর্তাকে নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে ফেসবুকে অনেকেই এমন কিছু লিখেছেন, যা এই বাহিনীটির সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি করেছে। সুতরাং এই আইনের বলে পুলিশ বাহিনী সস্পর্কে ওই সব লেখালেখির কারণে কি কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে?

৪৪টি ধারা সংবলিত নতুন এই আইনে এ রকম আরো বেশ কিছু বিধান রাখা হচ্ছে, যেগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের নামে যে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফলে সরকারের উচিত হবে, আইনটি কেবিনেটে তোলার আগে এটির খসড়া নাগরিকদের মতামতের জন্য যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। এ ক্ষেত্রে একটি নির্ধারিত সময় বেঁধে দিতে হবে যাতে ওই সময়ের মধ্যে নাগরিকরা আইনটি সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে পারে। এরপর সেখানে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন করে কেবিনেটে তোলা হলে এটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক বিতর্ক এড়ানো যাবে।

সবশেষ কথা হচ্ছে, আইনের ধারা যত কঠোর বা কোমল হোক না কেন, সেটির প্রয়োগ নির্ভর করে সরকারের ইনটেনশন বা ইচ্ছের ওপর। খুব দুর্বল ধারা দিয়েও সরকার চাইলে যে কাউকে ফাঁসাতে পারে। যেমন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অতিপ্রয়োগ আমরা দেখেছি। আবার খুব কঠোর কোনো ধারাও অকার্যকর হয়ে যেতে পারে যদি সর‌কার সেটি প্রয়োগ করতে না চায়।

ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লক্ষ্য যদি হয় প্রকৃত প্রস্তাবেই সাইবার নিরাপত্তা বিধান এবং সেই সাথে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো কার্যক্রম প্রতিরোধ করা, তাহলে এ নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হবে না। কিন্তু যদি এ আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হয় বাকস্বাধীনতা হরণ বা ভিন্ন মত দমন, তখন আইনের ব্যাখ্যা নিজেদের মতো দিয়ে সহজ-সরল বিষয়কেও জটিল করে তুলতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুরোটাই নির্ভর করবে আইনটি যারা প্রয়োগ করবে, তাদের ওপর। তবে আমাদের আশা করতে দোষ নেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো ধারা নিয়ে ৫৭ ধারার মতো আতঙ্ক তৈরি হবে না।  

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর