দেশ সঠিক পথেই চলছে, তবে

Looks like you've blocked notifications!

ঘটক নিয়ে ছেলে গেছেন পাত্রীপক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে। আগেই বলা ছিল ঘটক কিছুটা বাড়িয়ে বলবেন। তবে বেশি বাড়িয়ে বললে পাত্র কাশি দেবে, তাতেই ঘটক বুঝে যাবেন বেশি হয়ে যাচ্ছে। তো সব কিছু ভালোভাবে চলছিল। ঘটক পাত্রপক্ষের কী কী সম্পদ আছে তা বেশ বাড়িয়েই বলছিলেন পাত্রের সামনে। পাত্র মাঝে মাঝে কাশি দিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। একসময় পাত্রীপক্ষের একজন জানতে চাইলেন ছেলের কি কাশির সমস্যা আছে নাকি? ঘটক যথারীতি বাড়িয়ে বলা শুরু করলেন, ‘কাশি বলছেন কি, ছেলের তো হাঁপানির টান থেকে ব্রংকাইটিস এমনকি যক্ষ্মাও আছে।’ এবার বুঝুন ঠেলা! বছরখানেক ধরে একটা বিজ্ঞাপনেও এমন দেখানো হচ্ছিল ছেলে ৯৯ পার্সেন্ট ভালো। শুধু একটু...। এই তবে বা শুধুই মনে হয় যত নষ্টের গোড়া।

সম্প্রতি একদিনের ব্যবধানে বাংলাদেশকে নিয়ে দুটি জরিপের ফল এসেছে দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। একটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল থেকে, অপরটি ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট থেকে। টিআই বলছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি আগের মতোই রয়ে গেছে, একটুও কমেনি। আর আইআরআইয়ের গবেষণা বলছে, সঠিক পথেই এগুচ্ছে দেশ। টিআইয়ের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করার আগে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো, আমাদের দেশে টিআই ঘটা করে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করে বা সেটি নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন অবস্থায় বাদানুবাদ করি, অন্য কোনো দেশ বা সংবাদপত্র সেটি করে না। এমনকি টিআই রিপোর্ট প্রকাশের পরদিন অন্যান্য দেশের সংবাদপত্রগুলোও সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারই করেনি। টিআইয়ের বাংলাদেশের কার্যক্রমকেও এরই মধ্যে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। যদিও টিআইবি মনে করে তাদের রিপোর্ট স্বচ্ছ। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের আয়ের উৎস ও তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া টিআইবি শুধু সাংবাদিকদের ডেকে কেন এই রিপোর্ট প্রকাশ করে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

তবে একথা বলাই যায় যে, যা রটে তা কিছু না কিছু বটে! সে কারণে সার্বিক বিবেচনায় দুর্নীতির ধারণা সূচকে এবারও যে আমরা পরীক্ষায় পাস করতে পারিনি তার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে টিআইবি। সংস্থাটি বলছে, দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার অনুযায়ী অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু পদক্ষেপ গ্রহণ ও দুদকের প্রত্যাশিত সক্রিয়তা ও কার্যকারিতার অভাব এবং দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার ঘাটতি, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসা, ভূমি, নদী ও জলাশয় দখল, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অবৈধ লেনদেন, কালোটাকা সাদা করা ও বিদেশে অর্থপাচারের সুযোগের কারণে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি।

এ ছাড়া হলমার্ক, ডেসটিনি, রানা প্লাজা, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের দুর্নীতি, শেয়ারবাজারসহ উচ্চপর্যায়ের কেলেঙ্কারি, ক্ষমতাবানদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পদের বিষয়ে সরকারের একাংশের অস্বীকৃতির মানসিকতাও দেখা গেছে। টিআইবির এই কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে অপরাধ গোপন করার একটা মানসিকতা পেয়ে বসেছে সেটা আমরা নিকট অতীতে দেখতে পেয়েছি। সবচেয়ে ভয়াবহ, অন্যায়কে চাক্ষুস করার পরও রক্ষক ভূমিকা রাখছে অন্যায়ের পক্ষে।

এবার আসার যাক আইআরআইয়ের জরিপে। সেখানে দেশের ৬৪ ভাগ লোক মনে করে দেশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে। ৪৮ ভাগ মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর আস্থা রাখা যায়। তবে এই জরিপের সবচেয়ে ভালো দিক যেটা আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় নিজেদের সাফল্য বলে ধরে দিয়েছে সেটি হলো অর্থনৈতিক অগ্রগতি। কঠিন কথায় না গিয়ে বলা যায়, এখন দেশে রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ ভাগ মানুষ মনে করেন ভাত, ডাল, মাছ, ডিমসহ প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের মতো যথেষ্ট আয় তাদের আছে। এই একটা দিক দিয়ে বর্তমান সরকার সফল। বাংলাদেশের মানুষ আসলে শান্তিপ্রিয়। তাঁরা যে খুব ঝামেলা পছন্দ করেন, তা নয়। দুবেলা দুমুঠো খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারলেই তাঁরা খুশি। তাই গণতন্ত্রে যতই সমস্যা থাকুক না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি হলো না, কে জিতল বা কে জিতল না তাতে হয়তো তাঁদের সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ তারা সুখেই আছে। আবার বিষয়টা এমন যে, জনগণ হয়তো মনে করে যে সরকারই দেশ চালাক না কেন আমজনতার ভাগ্য তো তেমন পরিবর্তন হয় না। তা ছাড়া বিগত সরকারগুলোর অভিজ্ঞতা তাঁদের ভালো না। কাজেই মানুষ আগের চেয়ে ভালোই আছে। সে কারণে মামলা-হামলায় জর্জরিত সরকার বিরোধী দলগুলোও বছরখানেকের মধ্যে আন্দোলনের তেমন কোনো ইস্যু খুঁজে পায়নি আর রাজপথে নামাতে পারেনি সাধারণ মানুষকে। কারণ মানুষের এখন আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর সময় নেই। তাই তাঁরা মনে করেন, যেহেতু অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে তাই গণতন্ত্রে ছাড় দেওয়া যেতেই পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আগে সুদৃঢ় করতে হবে। পরে পূর্ণ গণতন্ত্রের কথা ভাবা যাবে।

তবে টিআই এবং আইআরআই উভয় সংস্থার জরিপে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, দেশের মানুষ মনে করেন, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এই মুহূর্তে অন্যতম সমস্যা। এ ছাড়া দুর্নীতি যেমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, কিন্তু হয়তো হাতে টাকা থাকার কারণে ৩৫ লাখ পেনশনের টাকা তুলতে ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে কিছুই মনে করছে না মানুষ। সরকারের এই ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে। বিশেষ করে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন ভুলেই গেছেন তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁরাই প্রভু হয়ে বসে আছেন। বিশেষ করে পুলিশ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন আরো ৫০ হাজার পুলিশ নেওয়া হবে। আরো ঘুষ, আরো দুর্নীতি আরো জনগণের হয়রানি যেন না হয় সেদিকে নজরটা দেবে কে? কারণ এরা ঢুকতেই যেটা ইনভেস্ট করবে পরবর্তীকালে জনগণের কাছ থেকেই তো তা তুলে নিতে হবে! কাজেই দেশ সঠিক পথে চলছে ঠিক আছে, তবে দুর্নীতিটা ঝেড়ে ফেলতে পারলে জনগণ ভূসি পেলেই খুশি হবে বেশি।

শান্তনু চৌধুরী : সাংবাদিক ও লেখক