অনলাইনে পাঠকের স্বাধীনতা ও একটি রায়

Looks like you've blocked notifications!

সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে বিবর্তন নিয়ে যে আলোচনা বিরাজমান, সম্ভবত তার পুরোটাই দখল করে আছে অনলাইন মিডিয়া। মূলত গত বছর পাঁচেক আগেও আলোচনা হতো অনলাইন মিডিয়া শক্তিশালী হলে কাগজের দৈনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ কী হবে! এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের মূলধারার কাগজগুলো এরই মধ্যে অনলাইন সংস্করণও চালু করেছে। মূলত যুগের যে ধাক্কা, সেটি সামাল দিতে গিয়েই কাগজের দৈনিকগুলো শক্তিশালী করতে বাধ্য হয়েছে নিজেদের অনলাইন টিমকেও।

তবে বিতর্ক মোড় নিয়েছে অন্য পথেও। যা কেবলই তৈরি হয়েছে ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালগুলোয় প্রকাশিত সংবাদের বিপরীতে পাঠকের দেওয়া মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। সাংবাদিকতার ব্যাকরণে এই বিষয়টিকে বলা হচ্ছে ‘ইন্টারেক্টিভ জার্নালিজম’। অর্থাৎ পাঠক আর কেবলই পাঠকই নয়, সংশ্লিষ্ট সংবাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা বা এ সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে বিষদ আলোচনা মন্তব্য আকারে পোস্ট করার সুযোগ পাবেন তারা। দুনিয়াজুড়ে এ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা কম হয়নি, হচ্ছে এখনো। কেউ বলছে, এভাবে সরাসরি পাঠকের মন্তব্য মৌলিক সাংবাদিকতাকে নষ্ট করবে, আবার কেউ বলছেন গণমাধ্যমে গণমানুষের মন্তব্য থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু আলোচনা শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। গড়িয়েছে অনেক দূর। কতদূর তা বলার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক বিতর্কের বিষয়বস্তু জেনে রাখা ভালো। ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালে পাঠকের মন্তব্য কীভাবে প্রকাশিত হবে বোধ করি এই বিতর্কটিই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলো ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’বিষয়ক আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। এখানে কেউ বলছে পাঠকের মন্তব্য প্রকাশ হবে সরাসরি আবার কেউ বলছেন না, মডারেশন ব্যতিরেকে পাঠকের মন্তব্য প্রকাশ সাংবাদিকতাসুলভ চর্চা হতে পারে না। কিন্তু একটি বিষয় সবাই মানে, সেটা হচ্ছে পাঠকের কোনো মন্তব্য সম্পাদকীয় নীতির বিরুদ্ধে গেলেই সেটা থেকে যাচ্ছে অপ্রকাশিতই।

কিন্তু পাঠকের মন্তব্যে যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মর্মাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এর সমাধান কী হবে? ২০১৩ সালের পর থেকে আলোচনার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল এই বিষয়টি। এ বছরের অক্টোবর মাসে ইউরোপের মানবাধিকার আদালত (ইসিএইচআর) এক রায়ে বলেছেন, প্রকাশিত সংবাদের নিচে পাঠক যে মন্তব্য করবে তার দায় কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট ইন্টারনেট নিউজ পোর্টাল এড়াতে পারে না। ওই রায় সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। মানবাধিকার ও মুক্ত মত প্রকাশের পক্ষে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো এ রায়ের বিরোধিতা করে বলেছিল, এই রায় যদি অপরিবর্তিত থাকে তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিনষ্ট হবে, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। উত্তর ইউরোপের দেশ ইস্তোনিয়ার একটি জনপ্রিয় ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালে একজন পাঠকের করা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের সূচনা হয়। ওই নিউজ পোর্টালটি পাঠকের মন্তব্যে কোনো মডারেশনে বিশ্বাসী নয়। এবং প্রতিদিন শত শত পাঠকের মন্তব্য মডারেট করাও সম্ভব নয় বলে দাবি তাদের।

এই রায় নিয়ে দীর্ঘ সমালোচনার পর সম্প্রতি একই ধরনের আরেকটি মামলার রায় লিখতে হয়েছে এই আদালতকে। এখানে হাঙ্গেরির একটি ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে মামলা করে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। চলতি মাসেই এই রায়টি আসে ইসিএইচআর থেকে। এই রায়ের ফলে আশাজাগানিয়া সম্ভাবনা ধরা দেয় সারা দুনিয়ার অনলাইন মিডিয়ার জন্য। এই রায়ে আদালত বলেন, ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালে তৃতীয় পক্ষের অর্থাৎ পাঠকের করা ‘অপমানজনক ও অভদ্র’ মন্তব্যের দায় নিউজ পোর্টালের হতে পারে না।

নিউজ পোর্টাল ‘ইনডেক্স’-এর নিয়োজিত আইনজীবী মামলার শুনানিতে বলেন, বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে পাঠকের মন্তব্যের জন্য সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করা উচিত নয়, এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চর্চায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আইনজীবীর এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আদালত বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত পাঠকের মন্তব্য কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না তৈরি করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা ব্যক্তির অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে।

এর আগে হাঙ্গেরির একটি আদালত এই মামলায় ওই কোম্পানীর পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে, ইসিএইচআর রায়ে বলা হয়, হাঙ্গেরির আদালত অধিকার রক্ষা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সারা পৃথিবীতেই কোনো নতুন ঘটনায় বিচার চলাকালে বা রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচারক উভয় পক্ষই একই ধরনের ঘটনায় অন্য দেশের আদালতের রায়কে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ তথা সারা পৃথিবীর অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশকালীন এই রায়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

বিশেষ করে সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য যে নীতিমালা প্রকাশ করতে যাচ্ছে, তার কোথাও পাঠকের মন্তব্য বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এই রায়টি গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অবশ্যই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী