মেট্রোরেল

উন্নয়নের ছোবল নয়, ছোঁয়া চাই

Looks like you've blocked notifications!

শুরুতেই মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ, তারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ট্যাগ না দিয়ে মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে নেওয়ার পক্ষে তাঁদের যুক্তি তুলে ধরেছেন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। একটা অ্যানিমেশনও দেখিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালস্’ বোঝেন। তাঁরা দাবি করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রো না গেলে বর্তমানের #রুটবদলাও #ChangeMetroRoute-এর চেয়েও তীব্র আন্দোলন হতো। তাঁদের অনুমানের জন্যও ধন্যবাদ।

তবে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালস্’ বোঝার অনুমান করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে আন্ডারএস্টিমেট করে গেলেন, এটাই ঠিক বুঝলাম না। এ প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে তাঁরা রুদ্ধদ্বার গোপন বৈঠক করেছেন সেই ২০১১ সালে। কোথায়, তখন তো কোনো প্রেস কনফারেন্স হয়নি! তাহলে তখন কি তাঁরা বিষয়টা অনুমান করে নিয়েছেন? আবার এখন প্রেস কনফারেন্স করার কথা মাথায় এলো! বলি, মেট্রোর বিষয়গুলো খোলাসা করে প্রেস কনফারেন্স করলে কি ক্ষতি হতো?

১.

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলা হচ্ছে, মেট্রোর রুট নির্ধারণ করা হয়েছে সেই ২০১১ সালে। তাহলে কেন এখন বিতর্ক উঠছে? তাঁরা কি জানেন না প্রকল্পের ইআইএ (Environmental Impact Assessment) এসেছে ২০১৫ সালের নভেম্বরে (জি, ঠিকই পড়েছেন ২০১৫ সালে!‍)? তাঁরা প্রকল্পের রুট করেছেন ২০১১ সালে, কিন্তু প্রকল্পের ‘ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভে’ করেছেন ২০১৫ সালের জুন মাসে (জি, এটিও ২০১৫ সালে)। একই সময়ে নভেম্বরের শেষের দিয়ে চারুকলার সামনে ও টিএসসিতে খোঁড়াখুঁড়ি করে মেট্রোর ভূমি জরিপের কাজ শুরু হয়।

নভেম্বরের এই ডকুমেন্ট এবং জমি খোঁড়া দেখে, তথ্য হাতে পেয়ে নিশ্চিত হয়েই তো শিক্ষার্থীদের ভেতরে জেগেছে শঙ্কা। কারণ, এরা যুক্তি দিয়েই মুক্তিতে বিশ্বাসী। সব দেখে, শুনে, পড়ে নিশ্চিত হয়েই ২০১৫-এর ডিসেম্বরে তারা স্লোগান তুলেছে, ‘উন্নয়নবিরোধী নই, বিকল্প রুট চাই’, ‘মেট্রোরেল চাই, তবে বিকল্প রুটে’।

২.

মেট্রোরেল ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে যাঁরা নিতে চাইছেন, তাঁদের যুক্তি হিসেবে বলছেন—

**মেট্রো রেল হলে দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীরা খুব সহজে এবং দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবেন।

**আবাসিক হলগুলোর ওপর চাপ কমবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসের উল্টো রাস্তায় চলার দৌরাত্ম্য কমবে।

আচ্ছা, মেট্রোরেল যদি শাহবাগ থেকে বিকল্প রুটে যায় এবং শিক্ষার্থীরা শাহবাগ স্টেশনে নামে, তাহলে ওপরের কোন যুক্তিটি বাধাগ্রস্ত হয়?

প্রপাগান্ডার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, টিএসসি স্টেশন থেকেই শিক্ষার্থীরা ক্লাসের রোলকলের উত্তর দেবে ‘উপস্থিত’! স্টেশন টিএসসির পাশে হলে শাহবাগে স্টেশনের প্রায় সমান দূরত্ব/রিকশা ভাড়া পার করেই তো ক্লাসে যেতে হবে তাদের।

ওপরের হাস্যকর যুক্তির তুলনায় মেট্রোরেলের প্রেস কনফারেন্সে বরং ভালো একটা যুক্তি দেওয়া হয়েছে। ওই প্রেস কনফারেন্সে জানানো হয়েছে, মেট্রোরেল শাহবাগ দিয়ে মৎস্য ভবন যেতে হলে বারডেম, ঢাকা ক্লাবের একাংশ ভাঙতে হবে। কারণ, শাহবাগ থেকে বাঁক নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত স্পেস নেই।

বিষয়টি নিয়ে আমি দুজন স্থপতির সঙ্গে কথা বলেছি (তাঁদের অনুমতি নেই বলে নাম প্রকাশ করতে পারছি না।)। তাঁরা দুজনই জানিয়েছেন, শাহবাগ-মৎস্য ভবনের বাঁকটা আসলেই শার্প। কিন্তু বিকল্প সম্ভব। সে ক্ষেত্রে রাস্তার পূর্বপাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর দিয়ে অথবা শিশুপার্কের পাশ দিয়ে এই লাইন নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এতে প্রস্তাবিত রুটের একই 'edge' অনুসরণ করে মেট্রো অগ্রসর হতে পারবে। একজন বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর দিয়ে রুট গেলে পূর্ব দিকের রাস্তার পাশে এমন কোনো মুখ্য স্থাপনাও নেই, যেটা ভাঙতে হবে।

সমস্যার তৈরিই হয় সমাধানের জন্য। আমি নিশ্চিত, আগামীকাল যদি প্রধানমন্ত্রী রুট বদলের জন্য সম্মতি দেন, সে ক্ষেত্রে এই এরাই শাহবাগ থেকে প্রেসক্লাব যাওয়ার অন্তত ২০টা রুট বের করে ফেলবেন। প্রয়োজন একটু সদিচ্ছা শুধু। কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? ঢাবিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করার আগে আরেকটু ভাবুন। এটা একবার হলে আর পরিবর্তন করা যাবে না। চেষ্টা করুন সম্ভাব্য সব বিকল্পের। প্রকল্পের রিপোর্টেই একাধিক বিকল্প রুটের উল্লেখ ছিল। সেগুলো বিবেচনা করুন।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এসেছে সেটা হলো, বলা হচ্ছে এবার রুট বদল করতে গেলে প্রকল্প পিছিয়ে যাবে। এমনকি অনিশ্চিতও হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু এর মধ্যেই দেখলাম মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার (যেটাতেও দুটি বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর পয়সা আছে) ভুল ডিজাইনের কারণে অন্তত ৬০টি পিলার ভাঙতে হচ্ছে, নকশা পরিবর্তন হচ্ছে এবং বাজেট বাড়ছে কয়েকশ কোটি টাকা। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রয়োজন হলে কাজের মাঝপথেও নকশা পরিবর্তন যায়, বাজেটও বাড়ে।

ঢাবিকে নিয়ে এই এক্সপেরিমেন্টের আগে ভাবুন, আবার ভাবুন। বিষয়টা গোঁ ধরে পড়ে থাকার নয়, শিক্ষার্থীরা তো মেট্রোরেলের বিপক্ষে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেলের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনা করে তারা প্রস্তাব করেছে রুট পরিবর্তনের, যেটা প্রকল্পের হিস্ট্রিক্যাল ইমপরট্যান্স বা প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভেতে উল্লেখ আছে।

৩.

মেট্রোর রুট বদলের দাবির কারণ শুধু ‘শব্দ আর শিক্ষার পরিবেশ’ নয় (আবারও বলছি, শব্দ আর পরিবেশদূষণ তুলনামূলক গৌণ।) এটা বলার কারণ, খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই যুক্তি দিচ্ছেন, ‘শব্দদূষণ হবে না, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে না।’ অনেকেই তো আরেক কাঠি সরেস হয়ে #রুটবদলাও ওয়ালাদের বলে দিচ্ছেন এরা মেট্রোরেলই চায় না, উন্নয়নবিরোধী। কেউ কি নেই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুরো মেসেজটা দেওয়ার?

আগের লেখায় (লিংক: http://bit.ly/1KiSmpe) বিস্তারিত বলেছি, এখন সংক্ষেপে বলে যাই। শিক্ষার্থীরা মেট্রোর রুট বদলের দাবি করেছে যেসব কারণে সেগুলো হলো:

ক) ক্যাম্পাসের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোর ঝুঁকি :

ছবি : লাল বৃত্তগুলো মেট্রোরেল রুটে আশপাশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনাকে নির্দেশ করছে।

ওপরের ছবিটি লক্ষ করুন। প্রকল্পের ইআইএ ডকুমেন্টেই দেখা যাচ্ছে পুরো মেট্রোরুটের অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সন্নিহিত।

জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালা বা আইনানুযায়ী ‘কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা অথবা পুরাকীর্তির ২০০ বর্গমিটার এলাকায় কোনো ভারী স্থাপনা তৈরি করা যাবে না’।

এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের করা প্রকল্পের প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভের উপসংহারে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, যে তাঁরা এই সার্ভেতে ঢাকা শহরের বুদ্ধিজীবী, স্থপতি, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকদের ইন্টারভিউ নিয়েছেন এবং তারা পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল রেকর্ড, প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় টিএসসি-দোয়েল চত্বর দিয়ে রুট না নিয়ে শাহবাগ-মৎস্য ভবন দিয়ে নেওয়া হোক। আগ্রহীদের জন্য ওই সার্ভের উপসংহারটার ছবি দেওয়া হলো :

অথবা এই লিংক থেকেও পড়তে পারেন: http://imgur.com/hVsDE7Z

খ) ক্যাম্পাস তার চিরচেনা ল্যান্ডস্কেপ হারাবে। রাজু ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে।

(মেট্রো কর্তৃপক্ষ দাবি করছে মেট্রোরেলের ফলে রাজু ভাস্কর্যের কোনো ক্ষতি হবে না। অথচ রাজু ভাস্কর্যের ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী বলছেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য একটি ৩৬০ ডিগ্রি স্থাপনা। এর মাথার কাছে একদিক দিয়ে মেট্রোরেলের রুট হলে এর ত্রিমাত্রিক যে তাৎপর্য, সেটা হারিয়ে যাবে। সিমেন্টের আস্তর ধ্বসে পড়বে, ভাস্কর্যে ফাটল ধরতে পারে।’ কী আর বলব?)

গ) টিএসসি, চারুকলা, বাংলা একাডেমি সন্নিহিত এলাকাজুড়ে সাংস্কৃতিক বলয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে নববর্ষের বর্ণাঢ্য আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা।

(আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরের বছরই টিএসসি, চারুকলা, বাংলা একাডেমি এই জায়গার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে এর সন্নিহিত এলাকাজুড়ে সোনার বাংলা সাংস্কৃতিকবলয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সোনার বাংলা সাংস্কৃতিকবলয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসে আবারও সাংস্কৃতিকবলয়ের কাজ পুনরায় শুরু করে। বলা হয়েছিল, এই বলয়ের মহাপরিকল্পনা বিঘ্নিত হয় এমন কাজ করা হবে না। নিচে মেট্রোরেলের থ্রি-ডি ছবিটি দেখুন। রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে ওপর দিয়ে চলা মেট্রোরেল বা তার পিলারের কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং বলয় বিঘ্নিত হবে কি না দেখে নিজেই বলুন।)

ঘ) শব্দ, দূষণ এবং কম্পনজনিত ক্ষতি

(মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের শব্দ ও কম্পন নিয়ে টেকনিক্যাল ব্যাখ্যায় আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। কারণ যে প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে, তাতে মেট্রোরেল চলার সময়ে শব্দ ও কম্পন সীমিত করা যাবে বলে আমার মনে হয়েছে।

শব্দ ও কম্পন-সংক্রান্ত একটা প্রশ্নের জবাব আমি পাই নাই অথবা সন্তুষ্ট নই। সেটা হলো আগামী চার বছর বা তার বেশি সময়জুড়ে (মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার দ্রষ্টব্য) চলা মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের সময় যে ‘আনঅ্যাভয়ডেবল’ দূষণ এবং কম্পনজড়িত সমস্যার কথা প্রকল্পের রিপোর্টে বলা হয়েছে সেটার কী হবে? )

ঙ) গণশুনানিতে উপেক্ষিত ঢাবির ফিডব্যাক

মেট্রো কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিল সেই ২০১১ সালে। গোপন বলছি কারণ, রুদ্ধদ্বার সেই বৈঠকে কী হয়েছে তথ্য কোথাও তারা প্রকাশ করেনি। তারাও না, ঢাবি প্রশাসনও না। কিন্তু পুরো প্রকল্পে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে পরিবেশবিষয়ক মাত্র দুটি গণশুনানি হয়। এর মধ্যে দক্ষিণ পয়েন্টের একমাত্র (জি, একমাত্র প্রকল্পের ইআইএ রিপোর্টের ১৭২ নম্বর পৃষ্ঠা দৃষ্টব্য) ‘গণশুনানিটি হয় জাতীয় জাদুঘরে গত বছরের (২০১৫) ৭ই মে। সেখানে সাংবাদিক, ফুলের দোকানি, স্থপতি, চিকৎসকসহ বেশ কয়েকজনের মন্তব্য নেওয়া হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়া হয়নি। অর্থাৎ সচেতনভাবেই এড়ানো হয়েছে বিষয়টি।

চ) মেট্রোরেল ও যাত্রীদের নিরাপত্তা

আরেকটা বিষয় নিয়মিত না ঘটলেও সেটা উড়িয়ে দিতে পারেন না। সেটা হলো মেট্রোরেল কিংবা যাঁরা মেট্রোরেলের চড়বেন তাতে নিরাপত্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন তো নতুন কিছু নয়। নিয়মিত না হলেও ঝুঁকি কিন্তু থাকেই। ধরুন কোনো বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জোরদার আন্দোলন হচ্ছে তখন যদি ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মেট্রোরেলের আক্রমণ করে, ঢিল মারে কিংবা আগুন দেয় তাহলে কী হবে? জাতীয় জাদুঘরের সামনে কিংবা দোয়েল চত্বরে যদি আন্দোলনকারীরা কোনোভাবে মেট্রোরেল আটকে দেয়? হাজার হাজার মানুষের নিরাপত্তা কে দেবে? যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল চাইছেন, তাঁরা কি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে এই নিরাপত্তা ঝুঁকি কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?

৪.

ঘর পোড়া গরু আমরা। সব সময়ই ঠকেছি। তার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক চাপ গেছেই, অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক মিষ্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দিনশেষে, মিষ্টি খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিষ্টির খালি প্যাকেট ফেলে গেছে। ‘তবে তাই হোক’, ‘আবারও ঢাবিই আসুক বলিদানের মঞ্চে’ বলে এবার আর এড়ানো যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না তার কিছু প্রমাণ দিই।

১৯২১ সালে তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ ৮৭৭ শিক্ষার্থী ও ৬০ জন শিক্ষক এবং তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মিন্টো রোড, হেয়ার রোড, রমনা নীলক্ষেত ও প্রেসক্লাবের মোট ৬০০ একর জায়গা নিয়ে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। ২০১৬ সালে এসে ঢাবিতে আছে ১৩টি অনুষদ, ৭৭ বিভাগ, ১১টি ইনিস্টিটিউট, ২০টি হল, ৪০ হাজার শিক্ষার্থী এবং প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষক। কিন্তু জমি বাড়েনি একরতিও। এসে দাঁড়িয়েছে ১৭৭ একরে। রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল থেকে শুরু করে শিক্ষকদের বাসভবনের জমি মন্ত্রীদের বাসভবনের জন্য দিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই উদার নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

*১৯৭৬ সালে জাতীয় জাদুঘরকে তিন একর জায়গা ছেড়ে দেয় ঢাবি। কথা ছিল জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের ছেড়ে আসা চার একর জায়গা ও ভবনাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করবে। কিন্তু আজো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সে জায়গা দেওয়া হয়নি।

*১৯৯২ সালে সরকার পরমাণু কমিশনের পাশের জমি বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করতে সাভারে কমিশনের নতুন জায়গা নির্ধারণ করে। কিন্তু সাভারে কমিশন কার্যক্রম শুরু করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা হস্তান্তর করেনি।

*গ্রিন রোডের ৫.৯৯ একর জায়গা, গ্রিন সুপার মার্কেট , কাঁটাবন মার্কেটের বেশিরভাগ দোকানই, রাজনৈতিক নেতা, কর্মচারীরা নামমাত্র মূল্যে দখল করে ব্যবসা করে যাচ্ছে।

*শহীদ বুদ্ধিজীবী গোবিন্দ চন্দ্র দেব বা জিসি দেবকে চেনেন? তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন তাঁর ধানমণ্ডির সম্পত্তি। সেই জমি দখল করে খাজা আইনুদ্দীন চিশতী নামের এক পীরের খানকা শরিফের নামে দখল করা হয়েছে।

*এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানের জায়গা দখল করে বানানো হয়েছে অন্তত পাঁচটি মাজার ও খানকা।

*অমর একুশে হলের পাশের জায়গা দখল করে বানানো হয়েছে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি।

*১৯৫৬ সাল থেকে সাত বছর পর পর চুক্তি নবায়ন করে ব্রিটিশ কাউন্সিল ফুলার রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আটকে রেখে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

*স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থীদের ঘিঞ্জি বসবাসের মাঝেই হলের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি, নিউমার্কেট থানা থেকে যার দূরত্ব মাত্র কয়েক কদম।

এসব অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তৎপরতা ছিল না কখনোই; বরং দিয়েই গেছে। যার ফলে ৬০০ একর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সম্পত্তি ২৭৫.০৮৩ একর (ঢাকার বাইরের সম্পত্তিসহ)। এর মধ্যে মালিকানা সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খাজনা দেওয়া হয় ১৭৭ একরের। তার মানে বাকি ২৭৫.০৮৩ একরের থেকেও প্রায় ১০০ একর নাই। এই ৯৮ একর জমি কই, তা জানে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেও।

(ঢাবির জমি সংক্রান্ত তথ্যের জন্য আনিসুর রহমানের কাছে কৃতজ্ঞ)

৫.

উন্নয়ন বলতে আমাদের মাথায় ঢুকে গেছে দৃশ্যমান উন্নয়ন। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বলে একটা ব্যাপার আছে এবং এটা যে অবকাঠামোর চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ না। এ জন্যই এয়ারপোর্টের সামনে লালন ভাস্কর্য ভাঙলে আমরা চিৎকার করে উঠি, রবীন্দ্রনাথের মাটির ঘর ভাঙলে, সুরস্রষ্টা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের সংগীতাঙ্গন লয় হলে আমাদের এত গায়ে লাগে ক্ষুব্ধ হই এবং রাস্তায় নেমে আসি। কারণ, লক্ষ সোনার তানপুরা কেনার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য এখন বাংলাদেশের আছে। কিন্তু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তানপুরা আমাদের একটিই। এটার কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই, কোনো ক্ষতিপূরণ দিয়ে এটা কাভার করা যাবে না। এ জন্যই এর মূল্য অসীম, ক্ষতি অপূরণীয়। ঢাকা শহরে গোটা ঢাবি তেমনই। এরও কোনো স্পেয়ার কপি নেই।

ধূসর এ শহরে বেসামরিক মানুষদের, বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের যাওয়ার খুব বেশি সবুজ জায়গা নেই অথবা সব সবুজে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। তাই একটু সবুজ খুঁজতে বহিরাগত, সাবেক, মধ্যবিত্ত সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন এ ক্যাম্পাসে, একটু নিশ্বাস নিতে। অতি বহিরাগতের চাপে এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর শিক্ষার্থীরা পিষ্ট হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাসিমুখেই মেনে নেয়। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে, দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য মেট্রোরেল অবশ্যই প্রয়োজন। আমি মেট্রোর পক্ষে। তবে সেটা হোক বিকল্প পথে। মেট্রোরেল তার মতো করে পাশের বিকল্প রুট ধরে যাক। মানুষ একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গাটা অটুট থাক। মানুষ আসুক, মেট্রোরেলে করেই আসুক। আমরা মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করি। ঢাকার যানজটে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। ঢাবির জন্যও আমরা আরেকটু অপেক্ষা করতে পারব। উন্নয়ন আসলে ছোবল না হয়ে, ছোঁয়া হয়ে আসুক।

৬.

পরিশেষে, সরকার এবং ঢাবি কর্তৃপক্ষ, পক্ষে-বিপক্ষের শিক্ষার্থী, সাবেক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গলকামী সবাইকেই বুঝতে হবে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেট্রোরেলের রুট বদলের আন্দোলন কোনো হালুয়া-রুটির আন্দোলন না, নেতা হওয়ার আন্দোলন না, মেট্রোরেল বন্ধ করার আন্দোলনও না। তারা তাদের ক্যাম্পাসের ল্যান্ডস্কেপ, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বলয়ের সুরক্ষা চায়, সে জন্য চায় মেট্রোর বিকল্প রুট। দয়া করে এটাকে কেউ মেট্রো বন্ধের আন্দোলন বলে ম্যানিপুলেট করবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে সবাই সারা জীবনই নিয়েছে, একে এফোঁড়-ওফোঁড় না করে একটু বাঁচতে দিন।

আমার অদ্ভুত লাগে যখন বিমানবাহিনীর এক আপত্তিতে পুরাতন বিমানবন্দরের রুট বাতিল করা, সেটার কারণে প্রকল্প বিলম্বিত হলো, কত্তো ঝামেলা হলো তখন বর্তমান দিস্তার পর দিস্তার খরচকারী প্রতিবাদকারীদের একটা আপত্তি দেখিনি, দেখিনি কোনো কলাম, বা দীর্ঘ স্ট্যাটাস।

আগের গৌরবের জেল্লা কিছুটা মলিন হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এতো আগে অভাগা ভেবে নেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

আপনারা মেট্রোরেল, আপনারা সরকার, আপনারা যা খুশি বলেন, যা খুশি যুক্তি দেন, যে কয়টা পিলার ভাঙা সম্ভব ভাঙেন—আমি ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়েই যাবো যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হই। কারণ প্রিয় লেখক শওকত ওসমান ‘ক্রীতদাসের হাসি’তে বলেছিলেন, ‘যুক্তির পেছনে থাকে মুক্তির স্বপ্ন আর এই মুক্তির স্বপ্নই মানুষকে মানুষ বানায়।‘

এটাই আমার শিক্ষা, আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা।

 

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী