সাক্ষাৎকার
বরকতের রক্তে আমার জামা লাল হয়ে যায় : জসীম উদ্দিন আহমেদ
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ ভাষা অন্দোলনে অবদানের জন্য একুশে পদক পেলেন এবার। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার দুঃসাহসিক মিশনে যোগ দেন তিনি।
পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে বেলা ৩টার দিকে জসীম উদ্দিন আস্ত একটা ইট ছুড়ে মারেন পুলিশের ওপর। তাঁর ডান পাশে ছিলেন শহীদ আবুল বরকত। এ সময় পুলিশ আকস্মিকভাবেই গুলি ছোড়ে। জসীম উদ্দিনের গা ঘেঁষে ডান পাশে থাকা বরকত পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তাক্ত বরকতকে উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে জসীম উদ্দিনই প্রথম কোলে তুলে নেন। বরকতের রক্তে ভিজে যায় জসীম উদ্দিনের জামাকাপড়। তারপর আশপাশের কয়েকজন ছাত্র এসে বরকতকে হাসপাতালে নেন। হাসপাতালে বরকতের অপারেশন হয় কিন্তু বাঁচানো যায়নি।
বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হন বরকত। পুলিশের গুলির সম্মুখভাগ থেকে সেদিন ভাগ্যগুণে বেঁচে যান জসীম উদ্দিন। বাশার খানের নেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. জসীম উদ্দিন বলেছেন একুশের ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ।
বাশার খান : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে আপনি একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শিক্ষার্থীরা সব বাধা উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভাঙল। ১৪৪ ধারা ভাঙা ও শিক্ষার্থীদের মেডিকেলের সামনে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাই।
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ১৪৪ ধারা ভাঙতে ১০ জন ১০ জন করে বের হলো। প্রথম ৩টা গ্রুপকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল পুলিশ। এতে ১০ জন করে বের হওয়ার কৌশলটি ব্যর্থ হলো। তখন সিদ্ধান্ত হলো- ছোট ছোট গ্রুপে চার-পাঁচজন করে মেডিকেল কলেজের দিকে যাবে। আমি ও আমার রুমমেট শাহজাহান এবং আরো দু-তিনজন রওনা দিলাম মেডিকেলের গেটের দিকে। গেলাম অর্ধেক পথে। এখনকার মেডিকেল কলেজের মাঝখানে যে গেট, সেখানে।
বাশার খান : এখন যে শহীদ মিনারের পাশের গেট ও জরুরি বিভাগের মধ্যবর্তী গেট, সেটা ?
ড. আহমেদ : হ্যাঁ, ওইটাই ছিল সে সময়ের মেডিকেল কলেজের গেট। সেখানে গিয়ে দেখি পুলিশ ছাত্রদের বেধড়ক পেটাচ্ছে। আমি তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েকটি ইট ছুড়ে মারলাম। এরপর আমি আর শাহজাহান মেডিকেল কলেজের ভেতরে চলে গেলাম। হোস্টেল আর মেডিকেল কলেজের মাঝখানে একটা সাধারণ দেয়াল ছিল। দেয়ালটা ভাঙা ছিল- ভাঙা জায়গাটি দিয়ে যাওয়া-আসা করা যেত। আমরা সেখান দিয়ে মেডিকেল হোস্টেলের কম্পাউন্ডে ঢুকলাম। চারদিক থেকে এসে আরো অনেকে এরই মধ্যে হোস্টেলে জমা হয়েছে।
বাশার খান : তারপর?
ড. আহমেদ : পুলিশের সঙ্গে ঢিল ছোড়াছুড়ি ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলো। আমি ও শাহজাহান ঢিল ছুড়লাম। পুলিশকে একবার আমরা ধাওয়া দিয়ে মেডিকেল হোস্টেল থেকে বের করি, পুলিশ আবার আমাদের ধাওয়া দিয়ে ভেতরে ঢোকে। এভাবে অনেকক্ষণ চলল।
বাশার খান : ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া কয় ঘণ্টা যাবৎ চলল?
ড. আহমেদ : ১১টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় চার ঘণ্টা। বেলা আড়াইটা-৩টা পর্যন্ত। ঢিলাঢিলিতে আমাদের একটা সুবিধা ছিল।
বাশার খান : কী ধরনের সুবিধা?
ড. আহমেদ : মেডিকেলে তখন মেরামতের কাজ চলছিল। আস্তা, অর্ধেক ও টুকরা ইট ছিল সেখানে। আমি তখন আস্তো ইট ছুড়ে মারি পুলিশের ওপর। আস্তো ইট মারার এত শক্তি হঠাৎ করেই কোত্থেকে পেলাম জানি না।
বাশার খান : বয়স ৮৫ বছর হলেও আপনি এখনো সুঠাম দেহের অধিকারী- এটা আল্লাহর বিশেষ কৃপা। আমার মনে আছে, কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে এক তরুণের বিরক্তিকর আচরণে আপনি তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্র পাঞ্জা লড়াই তো দূরে থাক, বুড়ো বয়সে আপনার ফিটনেস ও জ্বলন্তস্ফুলিঙ্গের মনোবল দেখে চুপ হয়ে গিয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আপনি নিশ্চয়ই বলিষ্ঠ ও দুঃশ্বাসী তরুণ পিকেটার ছিলেন।
ড. আহমেদ : সেটা বলতে পারব না বাশার।
বাশার খান : তো আপনার ছোড়া ইটে কোনো পুলিশ আহত হয়েছিল কি?
ড. আহমেদ : ইট কিন্তু পুলিশের ওপরই পড়েছে। কে আহত হয়েছে তা দেখিনি। কারণ ইট মেরেই দৌড়ে হোস্টেলের ভেতর চলে আসি।
বাশার খান : পুলিশ কী করল তখন?
ড. আহমেদ : পুলিশ এমনভাবে ভেতরে ঢুকল- ছাত্রদের নির্দয়ভাবে বেধড়ক পেটাল। দৌড়রত ছাত্রদের পায়ে লাঠি ফিক্কা মারল। কিছুক্ষণ পর আমাদের পাল্টা ধাওয়ায় পুলিশ পিছু হটল। এবার আমি ও শাহজাহান, আমার ডান পাশে ছিল আবুল বরকত। বরকতের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আমার পরিচয় ছিল না।
বাশার খান : বরকত তো পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। আর আপনি বিজ্ঞান অনুষদের গণিতে।
ড. আহমেদ : হ্যাঁ। তো আমি শাহজাহান আর বরকত সে সময়ের ১২ নাম্বার ব্যারাকের বারান্দায়। ১২ নাম্বার ব্যারাক মেডিকেলের গেটের ৩০ গজের মধ্যেই হবে। আমার দুটি অর্ধেক করা ইট হাতে নিলাম। শাহজাহানের হাতেও ইট ছিল। বরকতের হাতে ইট ছিল কি না বা কী ছিল- সেটা খেয়াল করিনি। তখন এত কিছু খেয়াল রাখার তো পরিস্থিতিও ছিল না। তখন দেখি গেটের বাম পাশে কাঁটাতারের পেছনে তিনজন পুলিশ আমাদের দিকে রাইফেল তাক করেছে। তাদের পেছনে ১০-১৫ জন পুলিশ দাঁড়ানো। পুলিশ পজিশন নিয়েছে কিন্তু চিন্তা করি নাই যে গুলি করবে। এর মধ্যেই হঠাৎ গুলির আওয়াজ। প্রথম গুলিটা শাহজাহানের মাথার ওপর দিয়ে বাঁশের চালায় গিয়ে লাগল। ব্যারাকগুলোর চালা ছিল বাঁশের তৈরি। গুলিতে বাঁশের চালায় ধোঁয়া উড়ল। ঠ্রা ঠ্রা সমানে গুলি ছুড়ছে। কয়েকটা গুলি আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। একসঙ্গে তিনজন পুলিশের গুলি- অনেকটা মেশিনগানের গুলির মতো মনে হলো। বরকত আমার গায়ের সঙ্গেই দাঁড়ানো। পরনে খাকি প্যান্ট ও কালো ডোরার সাদা ফুলশার্ট ছিল। তাঁর বাম উরুর উপরিভাগে গুলিটা লেগেই ছিদ্র হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বরকত পড়ে গেল। বাম পা-টা হাত দিয়ে ধরে পেছনে নেওয়ার চেষ্টা করল। কলকলিয়ে স্রোতের মতো রক্ত বেরোতে থাকল। মুহূর্তের মধ্যেই রক্তে লাল হয়ে গেল বারান্দা। আমার হাতের ইট ফেলে বরকতকে কোলে নিলাম। বরকত আমার চেয়ে লম্বা ও সুঠাম দেহের ছিল। তাঁকে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। শাহজাহান এসে ধরল। আমার ৮-১০ ফুট পেছনে একটা লোক ছিল-পরে জেনেছি উনি কে? ১২ নাম্বার ব্যারাকের ঠিক পেছনেই ছিল ১৯ নাম্বার ব্যারাক। সেখান থেকে আরো দু-তিনজন দৌড়ে আসল।
বাশার খান : তখনো কি পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল?
ড. আহমেদ : না। বরকত পড়ে যাওয়ার পরপরই পুলিশ গুলি বন্ধ করে দেয়। শাহজাহান ও ওই কয়জন বরকতকে আমার কোল থেকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে গেল। সারা পথেই বরকতের রক্ত পড়েছে।
বাশার খান : বরকতের রক্তে আপনার শরীরও ভিজে গিয়েছিল নিশ্চয়ই?
ড. আহমেদ : আমার জামা-কাপড় বরকতের রক্তে লাল হয়ে যায়। শাহজাহানের জামা-কাপড় রক্তে ভিজে গেল। তো বরকতকে নিয়ে যাওয়ার পেছন পেছন গিয়েছিল ডাক্তার বর্তমানে অধ্যাপিক মির্জা মাজহারুল ইসলাম। মাজহারুল ইসলাম সে সময় মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। বরকতকে সার্জারি বিভাগের ডাক্তার এলিন সনের নেতৃত্বে অপারেশন শুরু হয়। মির্জা মাজহারুলও অপারেশন টিমের সদস্য ছিলেন। কিন্তু বরকতে বাঁচানো যায়নি। রাতে বরকত মারা যায়।
বাশার খান : সেটা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কি?
ড. আহমেদ : হ্যাঁ। ওই পরিস্থিতিতে আমাদের মাথায় ঢোকেনি যে, গুলিতে বরকতের উরুর ছিদ্রে চেপে ধরলে রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। হাসপাতালে নেওয়ার পথেও যদি কেউ চাপ দিয়ে ধরে রাখত, এত রক্তক্ষরণ হতো না। পরে ডাক্তার এলিনসন জানান, ‘গুলিতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যায় বরকত।
বাশার খান : ড. আহমেদ, এবার সামান্য পেছন ফিরে আসি। বরকতকে তারা নিয়ে গেল। তখন আপনি কোথায় গেলেন? পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করেনি?
ড. আহমেদ : বরকতকে নিয়ে যাওয়ার পরও ওই এলাকাটা স্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই দৌড়ে চলে গেল। আমি ১২ নাম্বার ব্যারাকে দাঁড়ানো ছিলাম। পুলিশের বন্দুক তখনো আমার দিকেই তাক করা ছিল। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিল সেখানে। পাশের পুলিশরাও চুপ। কিছুক্ষণ পর পুলিশের টার্গেট সরিয়ে নিল। তিন পুলিশ উঠে দাঁড়াল। আমার চোখ গেল বরকতের রক্তের দিকে। একটা নিশ্বাস ফেলে হাঁপিয়ে উঠলাম। রক্তে ১২ নাম্বার ব্যারাকের বারান্দা ভেসে গেছে।
বাশার খান : যে শাহজাহান সাহেবের কথা বললেন, উনি কি এখনো বেঁচে আছেন?
ড. আহমেদ : না। অনেক আগেই মারা গেছে। ভাষা আন্দোলনে তার অনেক অবদান রয়েছে। তাকে অবশ্যই ইতিহাসের আলোচনায় আনা উচিত। গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। তাঁর বাড়ি বর্তমান চাঁদপুরের মতলবে। মতলবে আমি একবার লোক পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু শাহজাহানের কোনো খোঁজ পাইনি।
বাশার খান : বরকতের রক্তে ভেজা জামা-কাপড় কি সংরক্ষণ করেছিলেন?
ড. আহমেদ : রেখেছিলাম। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দাউদকান্দি থেকে আমার আব্বা আমাকে দেখতে আসেন সলিমুল্লাহ হলের ১৩৩ নম্বর রুমে। আব্বা এসে বললেন, ‘তোমার মা তোমাকে নিয়ে যেতে আমাকে পাঠিয়েছে।’ বাবা-মা জানতেন যে, ২১ তারিখে পুলিশের গুলির সম্মুখভাগে ছিলাম আমি। আব্বাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। বরকতের রক্তমাখা কাপড় দেখালাম। আব্বা বললেন, ‘২০ তারিখ রাতে হঠাৎ করেই তোমার মায়ের বুকে ব্যথা হয়। ২১ ও ২২ তারিখ তোমার জন্য তোমার মা রোজা রাখেন।’ আমি অবাক হলাম। আমার গা ঘেঁষে পুলিশের এত গুলি গেল। আমি বেঁচে রইলাম। মায়ের দোয়ায় মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছি। আব্বাস উদ্দিনের গানের অংশটি মনে পড়ল- বিদেশে বিপাকে যারও বেটা মারা যায়/ পাড়াপড়শি না জানিতে জানে তারও মায়ও রে/ মাঝি বাইয়া যাওরে। একপর্যায়ে কেঁদে উঠলাম। সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজও আমার চোখে জল আসে।
বাশার খান : সন্তানের বিপদ-আপদে পড়ার খবর মা আগেই টের পায়। এ রকম বহু ঘটনার সত্যতা মিলেছে। এ ব্যবস্থাটা আল্লাহই করে দেন। তারপর কি বাড়ি চলে গেলেন?
ড. আহমেদ : না, সেদিন বাড়ি যাইনি। আমার আব্বা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। বিস্তারিত শুনে বললেন, ‘আমি তোমাকে নিতে এসেছিলাম। রেখে গেলাম। মায়ের ভাষার জন্য লড়াই করে যাও।’
বাশার খান : তো বরকতের রক্ষমাখা কাপড়ের কথা বলছিলেন-
ড. আহমেদ : ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয় প্রশাসন। আমি বাড়িতে চলে যাই। বাবার মাধ্যমে অনেকেই ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা জেনে যায়। বাড়িতে পৌঁছার পর এলাকার অনেক লোক আমাকে দেখতে আসে। বরকতের রক্তমাখা জামা-কাপড় ও জুতা মাকে দেখাই। মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বরকতের রক্তমাখা কাপড় বাড়িতেই ছিল। দীর্ঘদিন এগুলো যত্নেই ছিল। তারপর চলে গেলাম বিদেশে। অনেক বছর অবস্থান করলাম। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধ হলো। বাড়িতে আমাদের বাড়িঘর ভাঙা হলো কয়েকবার। দেশে এসে রক্তমাখা কাপড় আর খুঁজে পায়নি। কে কখন অন্যান্য কাপড়ের সঙ্গে ফেলে দিয়েছে- তাও জানতে পারলাম না। জানো বাশার, এতে আমার খুব আফসোস হয়। কেন আরো যত্ন ও গুরুত্ব দিয়ে কাপড়গুলো রাখলাম না। রক্তমাখা কাপড় থাকলে মাতৃভাষা আদায়ের রণক্ষেত্রে আত্মত্যাগের স্মৃতি আমার কবরে দিয়ে দিতে কাউকে বলে যেতে পারতাম।