মাহফুজ আনাম বিতর্ক : ২০০৭-০৮ কারণ না উপলক্ষ?

Looks like you've blocked notifications!
আলী রীয়াজ

ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে মামলা দায়ের করার ঘটনাবলিকে যাঁরা এতদিন অত্যুৎসাহী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বতঃপ্রণোদিত কার্যক্রম কিংবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আনুকূল্য প্রত্যাশীদের বাড়াবাড়ি বলে বর্ণনা করেছিলেন, আশা করি এখন তাঁদের ভিন্ন উপলব্ধি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার মামলার বিষয়ে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত দেন যে জনাব আনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্থায়ী করার ষড়যন্ত্রের যুক্ত ছিলেন; বলেন যে, “আর যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, তাহলে ষড়যন্ত্রকারীদের যারা জড়িত, গণতন্ত্র হত্যা করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার হচ্ছে, ঠিক সেইভাবে এদের একদিন সংবিধান ধ্বংস করার দায়ে বিচার করা হবে।” তিনি তাঁর দলের নেতাদের ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্যও উৎসাহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ এবং সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁদের ভিন্ন উপলব্ধি হচ্ছে, তাঁরা তা স্বীকার করতে আগ্রহী হবেন, আমি তা মনে করি না। বাংলাদেশে সম্ভবত আগামী কয়েক দশকে আত্মোপলব্ধি এবং ভুল স্বীকারের কোনোরকম ঘটনা আর ঘটবে না। কেননা, ৪ ফেব্রুয়ারি টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনাম যদি এ কথা স্বীকার না করতেন যে ২০০৭-০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারের আমলে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সরবরাহ করা সংবাদ প্রকাশ করে ভুল করেছেন, তবে তাঁকে আপাতত এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হতো না। এ পরিস্থিতি বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি, তা পাঠকের জানা আছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা এখন প্রায় একশর কাছাকাছি, যেগুলোর আইনি ভিত্তি নিয়ে আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছেন।

মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এ দফা আক্রমণের সূচনা স্থানীয় পর্যায়ে হয়নি, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তাঁর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়েই দলের কর্মীরা এই মামলাগুলোর সূচনা করেছে, ফলে এর প্রতি প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন সবার বোধগম্য ছিল, যদিও অনেকেই বিষয়টি উল্লেখ করেননি। মাহফুজ আনাম এই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তা নয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি ছবিকে কেন্দ্র করে সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রধান বার্তা সম্পাদক ও প্রধান চিত্রগ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং সংসদে তীব্র ভাষায় জনাব আনামের সমালোচনা করা হয়েছিল। এই দফায় আক্রমণের শুরুতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূসের উপস্থিতিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় যখন অধ্যাপক ইউনূসের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়, তখন আর এটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার দরকার হয় না, এটি ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান।

গত কয়েক সপ্তাহে সরকারি দলের সমর্থকরা যখন ২০০৭-০৮ সালের সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর দায় মাহফুজ আনামের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তখন তা তাঁদের নিজস্ব ব্যাখ্যা বলে মনে করার কারণ ছিল। কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই দায় চাপিয়েছেন; ফলে আমরা প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছি। শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজের বৈধতা দেবে। ওই সময়ে ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের ৯০ দিন পার হয়েছে এবং এই প্রশ্ন উঠছিল যে, ওই সরকার সংবিধানের বিধানের অতিরিক্ত সময় ক্ষমতায় থাকছে কি না। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০০৮ সালের ১৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে একই কথা বলেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ১১ মাসের নির্জন কারাবাসের কথা বলেছেন; যেকোনো নাগরিকের প্রতি এই আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত, বিশেষ করে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তো বটেই। কিন্তু সে সময়ে তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক ওই সরকারের এই রকম অমানবিক আচরণের বিষয়ে প্রতিবাদ করার তাগিদ অনুভব করেননি কেন, সেটা আমাদের বিস্মিত করে।

প্রধানমন্ত্রী মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে যা-ই বলুন না কেন, তাঁদের বক্তব্যে একটি বিষয়ে ঐকমত্য সহজে দৃষ্ট—সে সময়ে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা সাংবাদিকতায় ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এমন আচরণ করেছে যেন তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে, তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের কোনো কারণ নেই। কিন্তু ওই সংস্থার আচরণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে কোনো খবর পাওয়া যায়নি। একই বিবেচনায় ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশ যদি সেই সময়কার পরিস্থিতির কারণ হয়ে থাকে, অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে কি এই বক্তব্য একইভাবে কার্যকর? গত কয়েক সপ্তাহে যাঁরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁরা এও উল্লেখ করেছেন যে যাঁদের জবানবন্দি এসব তথ্যের উৎস, যাঁরা সেই সময়ে কথিত মাইনাস-টু’র অংশ হিসেবে দলের ভেতরেই সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন দলের কোনো বক্তব্য নেই।

এসব প্রশ্নের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল অবগত নয়, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এও মনে করার কারণ নেই যে এগুলোর যুক্তিগ্রাহ্য কোনো উত্তর পাওয়া যাবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দল কেন মনে করছে যে এ দুই সংবাদপত্র ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে তাঁদের এখন আক্রমণোদ্যত হওয়া দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর কেবল ২০০৭-০৮ সালে কে কী ভূমিকা পালন করেছে, তার মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে না। খুঁজতে হবে বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থার ওপরে। ২০০৭-০৮ কারণ না উপলক্ষ, কেউ সেই প্রশ্ন তুললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পরে ক্ষমতাসীন দল যতটা দুর্বল অবস্থানে ছিল, ২০১৫ সালের গোড়াতে যতটা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, এখন তারা সে অবস্থানে নেই। এখন দেশের সব প্রতিষ্ঠানের ওপরে তাঁদের সর্বব্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের লক্ষণগুলো কেবল স্পষ্টই নয়, ক্ষমতাসীনরা তা আড়াল করার প্রয়োজনও বোধ করছেন না। কেননা, ক্ষমতাসীনরা এখন বুঝতে পারছেন যে ক্ষমতার ব্যবহার ও শক্তি প্রয়োগের ভীতি তৈরি করেই তাঁরা যেকোনো ধরনের বিরোধিতার সম্ভাবনাকে তাঁদের অধীন রাখতে পারবেন।

অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যে বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে, সেখান থেকে বেরোতে দলটির সময় লাগবে। প্রতিকূল পরিবেশে সাংগঠনিকভাবে নিজেকে সংগঠিত করার জন্য যে ধরনের কৌশলের দরকার, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার, বিএনপির নেতারা তা এখনো আয়ত্ত করতে পারেননি। এ বিষয়ে তাঁদের কমিটমেন্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। খুব শিগগির বিএনপির নেতারা সেই কৌশল আয়ত্ত করবেন, এমন মনে করারও কারণ নেই। তাঁদের এই বিপর্যয়ের পেছনে যেসব কারণ, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দলের সখ্য, সেগুলো তাঁরা এখনো মোকাবিলা করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল সরকারের সমালোচনার, জবাবদিহির যে সামান্য প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাগুলো আছে, সেগুলোকে দুর্বল বা নিয়ন্ত্রণ করাকেই যথাযথ মনে করছে। সেই চেষ্টার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তাঁদের আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। অন্যদের জন্যও সেখানে শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে।

ফলে বাংলাদেশে যাঁরা একে এখনো গণমাধ্যমের প্রতি হুমকি বলে মনে করছেন না, তাঁরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জটা বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমই ত্রুটিমুক্ত নয়। ২০০৭-০৮ সালেই শুধু নয়, বর্তমানেও তাঁদের ভূমিকা অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৭-০৮ সালে ‘অজ্ঞাত সূত্র’ থেকে পাওয়া টেপের ভিত্তিতে সংবাদ লেখা ও প্রকাশের সঙ্গে ২০১৩ বা ২০১৫ সালে অজ্ঞাত সূত্রে পাওয়া টেপের ভিত্তিতে লেখা সংবাদের মধ্যে পদ্ধতিগত বা নীতিগত পার্থক্য কোথায়—সে প্রশ্ন কি কেউ তুলছেন? এ প্রসঙ্গে অতীতে গণমাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র বা টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া এবং একজন সম্পাদককে আটকের ঘটনার প্রশ্নও উঠবে। প্রশ্ন উঠবে রহস্যময়ভাবে প্রাপ্ত টেপ প্রচারের পটভূমিকায় আটক একজন রাজনৈতিক নেতাকে বিনা বিচারে এক বছর ধরে কারাগারে রাখার দায়িত্বের কতটা গণমাধ্যমগুলো নেবে। দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিকরা এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান নেবেন এমন আশা করার কারণ নেই। কিন্তু এই বিভক্তির ঊর্ধ্বে ওঠার মতো সাংবাদিক-সম্পাদক নেই—এ কথা কি সাংবাদিকদের জন্য, সম্পাদকদের জন্য গৌরবের? রাজনীতিতে যে শক্তিগুলো এখনো বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে, তারা কি এই ঘটনাপ্রবাহের রাজনৈতিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে অপারগ না অনীহ?

আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক