মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং নতুন প্রজন্মের ভার্চুয়াল জগৎ

Looks like you've blocked notifications!

পার হয়ে গেছে সাড়ে তিন যুগের বেশি সময়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় শোষণ-বঞ্চনার শিকার বাংলাদেশ।

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পাওয়ার পরও আমরা কি সত্যিকারের মুক্তি পেয়েছি? স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী এসে চেষ্টা করেছে আমাদের এ মহান অর্জনকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের বা বিকৃতির। চেষ্টা চলছে এখনো! অনেক অজানা তথ্যের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এখনো বিভ্রান্তি ছড়ায় কেউ কেউ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সপ্তম নৌবহরের ভূমিকা কী? আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, চীন তথা পশ্চিমা বিশ্ব—কার কেমন ভূমিকা? স্বাধীনতা-সংগ্রামে শহীদের সংখ্যা কত? স্বীকৃতি কে আগে দিয়েছিল—ভুটান না ভারত? নানা প্রশ্ন এখনো উঁকি দেয় মনে। স্বাধীনতার এত বছর পার হয়ে গেলেও এ ধরনের অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্তি হন অনেকে। আদৌ কি মুক্তি পেয়েছি আমরা? নাকি বন্দি আছি ভুল তথ্যে ভরা কোনো এক মহাসমুদ্রের কোনো এক নির্জন দ্বীপে?

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ ব্যাপক। বর্তমান সরকারও নতুন প্রজন্মের সামনে বাঙালির এ বীরত্বগাথা সঠিকভাবে উপস্থাপনে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে জানার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভার্চুয়াল জগৎ। মুক্তিযুদ্ধ লিখে সার্চ দিলেই অতি সহজে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানা-অজানা তথ্য পেয়ে যায় সবাই। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি এখানেই। গুগল বা অন্য কোনো সার্চ ইঞ্জিনে কেউ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভেসে ওঠে অনেক রেজিস্টার্ড ও নন-রেজিস্টার্ড সাইট। বেশ কিছু সাইটে ভেসে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তির তথ্য। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অথবা কোনো একটি মতাদর্শের পরে লেখা আত্মস্থ করে সেভাবেই গড়ে তোলেন নিজেদের মনমানসিকতা। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রজন্মের মাঝে গড়ে উঠছে মতাদর্শের দূরত্ব। অথচ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার কথা নয়। এক জাতি, এক ইতিহাসই আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাম্য। এমনটা হওয়া উচিতও নয়।

এই বাস্তবতায় একদল উদ্যমী তরুণ নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জানানোর জন্য নেমেছেন অনলাইন যুদ্ধে। নিয়েছেন দুই বছর মেয়াদি একটি যুদ্ধপ্রকল্প।

প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হৃতহৃ ইসলাম বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়; কিন্তু তাদের কাছে সবচেয়ে বড় বাধা হলো নির্ভুল সোর্স। আর এরই বাস্তবতায় কাজে নেমেছি আমরা।’ প্রকল্পের আরেক ব্যবস্থাপক রাইসা সাবিলা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে সঠিক ও বিতর্কে ঊর্ধ্বে থাকা ইতিহাস হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ১৫ খণ্ডের এই বিশাল সংকলনটি বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারের আমলেই পুনর্মুদ্রণ হয়েছে কোনোরকম বড় ধরনের সংযোজন বা বিয়োজন ছাড়া। তাই এ সংকলন ইউনিকোডে রূপান্তরের মাধ্যমে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছি আমরা।’

প্রকল্পের আরেকজন উপব্যবস্থাপক মেহজাবীন বাঁধন বলেন, ‘ইউনিকোডে রূপান্তরিত হলে যেকোনো ডিজিটাল যন্ত্রে পাঠযোগ্য হবে এই দলিলপত্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ১০০ তরুণ ফেসবুকের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছেন। এতে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি আছেন প্রবাসী তরুণরাও। আছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। আছেন শিক্ষক মাঈমুনা তাসনিম, আছেন ছাত্রী রেনেসাঁ আসলাম। প্রকল্পটি শুরুর আগে সম্পূর্ণ অপরিচিত তারা। এভাবেই ছয় হাজার পৃষ্ঠার বাংলা টাইপিং। সঙ্গে ছয় হাজার পৃষ্ঠার অনুবাদ।’

সংকলনটি পিডিএফ থেকে ইউনিকোডে রূপান্তরিত করা প্রসঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাঈমুনা তাসনিম বলেন, ‘যিনি ইউনিকোডে রূপান্তরিত করছেন, তিনি ওই দলিল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ পাচ্ছেন।’ আরেক ব্যবস্থাপক রেনেসাঁ আসলাম বলেন, “পিডিএফ সংস্করণ থেকে মুক্তযুদ্ধের নির্দিষ্ট কোনো প্রেক্ষাপট, ঘটনা কিংবা ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ এই দলিল খণ্ডের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। বাংলা ইউনিকোড ফন্ট না হলে সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনো তথ্য। তাই সহজেই যাতে খুঁজে পাওয়া যায়, তাই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ১৫ খণ্ডের মধ্যে এরই মধ্যে অষ্টম ও ১৫তম খণ্ডটির কাজ শেষ। ফেসবুকের একটি ফ্যানপেজে তা অবমুক্ত করা হয়েছে। পেজটির নাম ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র থেকে বলছি’, যা তৈরি করার ১০ দিনের মধ্যে এক লাখের বেশি লাইক পড়েছে। এ থেকে স্পষ্ট, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে ব্যাকুল সবাই। এতে আমরাও উজ্জীবিত।”

রাইসা বলেন, “আমাদের ওয়েবসাইটের কাজ শুরু হয়েছে। এটি বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হবে দলিলপত্রভিত্তিক একটি স্থায়ী আর্কাইভ। পাশাপাশি একটি অ্যানড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন তৈরির উদ্যোগও নেওয়া হবে, যেটি হবে মূলত অনলাইনে তথ্য খোঁজার অ্যাপ্লিকেশন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কিছু খুঁজতে চাইলে ওয়েবসাইটটির সব দলিল সমন্বিতভাবে রি-ডাইরেক্ট হবে। অর্থাৎ কেউ যদি ‘সপ্তম নৌবহর’ সম্পর্কে দলিলপত্রভিত্তিক কিছু জানতে চান, তবে সেখানে সপ্তম নৌবহর লিখে সার্চ দিলেই উঠে আসবে এ সম্পর্কিত সব তথ্য। পাশাপাশি থাকবে সে বিষয় সম্পর্কিত কিছু ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও অন্যান্য উপাত্ত।”

যে কেউ চাইলে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র থেকে বলছি’ নামক ফেসবুক পেজটিতে (facebook.com/muktizuddho1971) মেসেজ পাঠিয়ে এ মহান উদ্যোগে যুক্ত হতে পারেন। আরো ১০০ জনকে নেওয়া হবে বাংলা ইউনিকোডে রূপান্তরের এই কাজে। দল-মত-বর্ণ-জাতি ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে এই উদ্যোগে সবাইকে স্বাগতম। তথ্য হোক উন্মুক্ত। আমাদের পরিচয় হোক শুধুই আমরা বাঙালি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দ্বারা।

লেখক : প্রকল্প ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র থেকে বলছি।