মীর কাসেমের ফাঁসির রায় বহাল

মুছে যাবে কান্নার দাগ

Looks like you've blocked notifications!

বিশ বছর বা তারও বেশি সময় আগে আন্দরকিল্লা ‘মহামায়া হোটেলে’র সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম কারো প্রতীক্ষায়। সে সময় চোখে পড়েছিল মীর কাসেমের নির্যাতন কেন্দ্রটি। এর পর সাংবাদিকতার সুবাদে বিষয়টি নিয়ে লেখা হয়েছে অনেকবার। সবচেয়ে যে বিষয়টি অবাক করেছে তা হলো, ওখানে নির্যাতনের শিকার যাঁরা হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন বা যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের বর্ণনা এতটাই শিউরে ওঠার মতো, যা শুনলে মনে হবে কোনো রূপকথার ভয়ংকর রাক্ষসের অত্যাচারের গল্প শুনছি। হরর মুভি দেখার পর যেমন বেশ কিছুক্ষণ এর রেশ থেকে যায়, ঘোরের মধ্যে থাকতে হয়, তেমনি ডালিম হোটেলে (মহামায়া হোটেলের নাম, পরে ডালিম হোটেল রাখা হয়) মীর কাসেমসহ তাঁর সহযোগীদের অত্যাচারের বর্ণনাও তেমনি ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় মানুষকে। এখনো যেন কান পাতলে শোনা যায় সে কান্নার শব্দ।

জানা যায়, একাত্তরে মীর কাসেম আলী পরিচিত ছিলেন ‘বাঙালি খান,’ বদর বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক, চট্টগ্রাম গণহত্যার নায়ক হিসেবে। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তবে জামায়াতের আর্থিক জোগানদাতা হিসেবে তাঁর নাম সবার আগে আসে। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছেন। লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জামায়াতের চুক্তির কপি এবং টাকা দেওয়ার রসিদ রয়েছে সরকারের কাছে। মীর কাসেম উচ্চমূল্যে টবি ক্যাডম্যানের সঙ্গে চুক্তি করে দেশি-বিদেশি মহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

মীর কাসেম আলীর বাবা তৈয়ব আলী ছিলেন চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মচারী; রহমতগঞ্জ এলাকার সিঅ্যান্ডবি কলোনিতে ছিল বাসা (ডালিম হোটেলের কাছাকাছি)। একাত্তরে কাসেম চট্টগ্রাম শহর শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন এবং সেই সূত্রে আলবদর বাহিনীর নেতা। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে মীর কাসেম ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) গঠন করেন। এর পর চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা—সব খাতেই বিচরণ ঘটে তাঁর এবং বলা যায়, প্রতিটি সরকারই তাঁকে সহায়তা করেছে। বিজয়ের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে ৩৫০ জন বন্দিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

এত এত যাঁর টাকার ক্ষমতা, সর্বোচ্চ আদালতে তাঁর রায় নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের অভ্যন্তরীণ মহলের কয়েকজনের বক্তব্য সেই আলোচনাকে আরো উসকে দিয়েছিল। আবারও প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কথাটি খুব মনে ধরেছে। তিনি বলেন, ‘বিচারাধীন মামলার ভালো বা মন্দ কোনো কিছু নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। এখন যেভাবে বিতর্ক তোলা হচ্ছে, তাতে বলতে হয় বাংলাদেশ একটা অদ্ভুত দেশ।’

তবে সবকিছুর পরও শেখ হাসিনা সরকার আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার কোনো শক্তিই বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার সফল না হয়ে মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকার ঘটনা তা-ই প্রমাণ করে।

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এরা বিশ্বমানবতার শত্রু। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে কাসেমের রায় বেশি করে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, চট্টগ্রাম শহরের ডালিম হোটেল ছাড়াও চাক্তাই এলাকায় দোস্ত মোহাম্মদ ভবন, দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলেও ছিল কাসেমের নির্যাতন কেন্দ্র। চট্টগ্রাম শহরের কোথাও মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছেন—সংবাদ পেলেই মীর কাসেম আলী ও তাঁর সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে অভিযান চালাতেন। নির্যাতনে অনেকেই মারা গেলে অথবা কাউকে মেরে ফেলার জন্য চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। একাত্তরে তাঁদের অনেককেই ধরে এনে ইলেকট্রিক শক, উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো, ঠোঁট থেঁতলে দেওয়া, হাত-পা ভেঙে দেওয়া, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করাই ছিল বদর বাহিনীর কাজ, যেগুলোর নির্দেশদাতা মীর কাসেম আলী।

এত এত সমালোচনা, জামায়াতের ভাঙচুর, হরতাল, জ্বালাওপোড়াওসহ নানা কিছুর পরও ঠেকানো যায়নি প্রত্যাশিত রায়। সে হিসেবে বুঝতে হবে, যতই বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হোক না কেন, ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘোরানো যায় না। রায়ের ফলে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। এখন রিভিউ আবেদনে যদি কোনো হেরফের না হয়, তা হলে রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার মধ্য দিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে সরকার।

লেখক : সাংবাদিক