সাক্ষাৎকার

স্বাধীনের পরও স্বপ্নে ভয়ে কাঁপতাম : স্বরূপা বেগম

Looks like you've blocked notifications!

১৯৭১ সালে স্বরূপা বেগম ১৩ বছরের কিশোরী। বাবা দরিদ্র কৃষক সফিউল্লাহ। মা মেহেরুন্নেসা। বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম নোয়াপাড়ায়। ১৯৭১ সালে সংসারের অভাবের তাড়নায় স্থানীয় ডাক্তার নূর আহমেদের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন তিনি। একাত্তরের আগস্ট মাসের কোনো একদিন স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে হানাদার বাহিনী ডাক্তার নূর আহমেদের বাড়িতে হানা দেয়। স্বরূপাকে ধরে নিয়ে যায় চৌদ্দগ্রাম থানায়। সেখানে তাঁকে পাকিস্তানি বাহিনী নির্যাতন করে। একসময় স্বরূপা পালানোর চেষ্টা করলে হানাদার বাহিনী তাঁর পায়ে গুলি করে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বরূপাকে উদ্ধার করে ভারতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। কিন্তু জীবন বাঁচাতে তাঁর বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়। দেশ স্বাধীন হলে সরকারিভাবে স্বরূপাকে দেশে আনা হয়। কয়েক বছর পর স্বরূপাকে বিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু বীরাঙ্গনা ও পঙ্গুত্বের কারণে স্বামী তাঁকে তালাক দেয়। বীরমাতা স্বরূপার এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাঁর বাড়িতেই। 

বাশার খান : আপনার বর্তমান আর্থিক অবস্থা কেমন?

স্বরূপা বেগম : আর্থিক অবস্থা বালা (ভালো) নাই। শুধু বাড়ির জায়গা কদ্দুর আছে। আর্থিক অবস্থা থাকলে তো আর মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম না। 

বাশার খান : আপনার মাথা গোঁজার জায়গা বলতে বাড়ির ওইটুকু জমি ছাড়া আর কিছুই নেই?

স্বরূপা বেগম : না, এইডাও আমার কাছে ছিল না। জামায়াতের এক নেতা জায়গা দখল করে নিয়েছিল। দলিলও তার কইরা রাখছিল। যদিও সে আমার মামাতো ভাই। পরে ‘মাটি’ নামে একটি সংগঠন সেই জায়গা উদ্ধার কইরা আমারে ফেরত দিছে। তারা ঢাকা নিয়া কিছু টাকাও দিছে। হের আগে-পরে কেউ কিছু দেয় নাই। সরকারও দেয় নাই।

বাশার খান : মুক্তিযুদ্ধের সময় বা তার আগে আপনাদের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?

স্বরূপা বেগম : একাত্তর সালের আগে বাবা যখন জোয়ান ছিল, তখন জায়গা-জমি ছিল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর সব জমি অল্প দামে ৫০০ টাকা শতাংশ দরে বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাই। পরে বাবা যুদ্ধের এক বছর আগে মারা যান। মা মামাগো বাড়িতে কাজকর্ম করে আমাদের খাওয়ায়। ভাইবোন ছয়জন। কারো অবস্থা বালা ছিল না। সত্তরের এপ্রিলের দিকে মানুষের বাড়িতে আমিও কাজ শুরু করি। 

বাশার খান : মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়কার কোনো স্মৃতি কি আপনার মনে পড়ে?

স্বরূপা বেগম : তখন শ্রীপুরের ডাক্তার নূর আহমেদের বাড়িতে কাজ করতাম। এক বছর কাজ করার পর যুদ্ধ শুরু হয়। আশপাশের মানুষ তো শুধু পালিয়ে ইন্ডিয়া গেছে। আমারও ভয় লাগছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভয় লাগত। স্বপ্নেও পাঞ্জাবিদের (পাকিস্তানি সেনাদের) দেইখা ভয় পাইতাম। কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার দিয়া উঠতাম।

বাশার খান : ডাক্তার নূর আহমেদের বাড়িতে আর কে কে থাকত?

স্বরূপা বেগম : শুধু বুড়া মানুষরা বাড়িতে ছিল। মুরব্বিরা বাড়িঘর রক্ষা করার জন্য ছিল। পাঞ্জাবিরা এসে অত্যাচার করত।

বাশার খান : আপনি নিজে পাঞ্জাবিদের দেখেছেন? 

স্বরূপা বেগম : সে তো বাজারের লগে ডেলিয়ে (প্রতিদিন) যায়। বাজারে চৌদ্দগ্রাম থানায় ওদের ক্যাম্প আছিল।

বাশার খান : আপনি মুরব্বিদের সঙ্গে থাকতেন। ওই বাড়িতে আর কোনো নারী থাকত না?

স্বরূপা বেগম : ডাক্তারের বউ জোয়ান ছিল। পাঞ্জাবিরা আওয়ার পর নূর আহমেদ ডাক্তার আর তার বউ বাপের বাড়িতে চলে যায়। তার বুড়ো বাপ আর একটা বেডা আর আমাকে বাড়িতে রেখে গেছিল। স্বাধীনের দুদিন পর তারা বাড়িতে আসে। 

বাশার খান : চৌদ্দগ্রামে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। থানার এক কিলোমিটারের মধ্যেই ডাক্তারের বাড়িতে আপনারা থাকতেন। যুদ্ধ বা গোলাগুলির খবর পেতেন?

স্বরূপা বেগম : এপ্রিল মাসের শুক্রবার পাঞ্জাবিরা আসে চৌদ্দগ্রামে। নামাজ পড়তে গেলে বোমা মারে। গুলি মারে। মুক্তিরা চলে যেত। আমরা সরে যেতে পারতাম না। হরিকুট জায়গা থেকে বোমা মারত। যেদিন পাঞ্জাবিরা এলো, সেদিন শুধু আমি আর ডাক্তার নূর আহমেদের বাবা বাড়িতে ছিলাম। কোনো জোয়ান মহিলা বাড়িতে থাকত না। শুধু কাজের বুয়াগুলো থাকত। আর কাজের জন্য যেসব পুরুষ লোক ছিল, তাদের একদিন পাঞ্জাবিরা লাইনে দাঁড় করাইছে গুলি করার জন্য। এই লাইনে ডাক্তার নূর আহমেদও ছিল। তাদের বাজারে দোকান ছিল, সে বাজারে গিয়ে দেখে থানায় পাঞ্জাবিরা ঘুরতেছে। দৌড়াইয়া গিয়া কয়, মাইনষেরে সরা, বউ-পোলাপান ছুটল শ্বশুরবাড়ির দিকে। সাইকেল নিয়ে বের হওয়ার সময় পাঞ্জাবিরা বাড়িতে ঢুকে পড়ছে। পরে ডাক্তার, তার চাচাসহ সবাইকে লাইন ধরাইছে। মাইরা ফেলবে। পরে ঘরে বুয়ারা সবাই কান্দি উটছে, আর তখন পাঞ্জাবিরা বলে—শালা ঘরে মুক্তি আছে। এই কইয়া তারা ঘরে ঢুকে। এরপর (এই সুযোগে) ডাক্তার অন্য বাড়িতে গিয়ে বাথরুমে পলায়ছে। পরে আর তাদের কাউকে গুলি করে নাই।

বাশার খান : আপনাকে ধরে নিয়ে গেল দিনের কোন সময়? 

স্বরূপা বেগম : বিহাল (বিকেল) ৩টার সময়। পাঞ্জাবি আসছে, আমি দেখছি। আমি ডরে ঘরে বসে আছি। মানুষ তো দেখলেই পলাইত। পাঞ্জাবিরা আইত কালা কালা পোশাক পরে। এরা বেলুচিস্তানের ছিল। কতগুলো খাকি পোশাকও পরত।

বাশার খান : তো, আপনি পালাননি কেন? 

স্বরূপা বেগম : আমি তো খুব ছোড (ছোট), বুঝি নাই আমারেও ধরব। পালাইয়াই যামু কোনে?

বাশার খান : ডাক্তার আহমেদ আপনার নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করেননি?
স্বরূপা বেগম : হ। বারিন্দার ভেতর মাটি গর্ত করা হইছিল, আমিসহ সবাইকে লুকিয়ে থাকার জন্য। এরপর মানুষে কয়—এক বোম পড়ব, সব আকাশে উড়ে যাবে। ভয়ে আরা মাটির গর্তে যাই নাই।

বাশার খান : তার পর আপনাকে ধরে নেওয়ার ঘটনা জানতে চাই।

স্বরূপা বেগম : আমাকে নিয়ে যায় বেলুচিস্তানের আর্মি। ওই বাড়িতে আমি আর একটা বুড়া ছিল। আমাকে ধরে থানায় নিয়া গেল। ডাক্তারের বাড়িতে ঢুকে একটা মহিলাকে অনেক অত্যাচার করছে।

বাশার খান : থানায় অন্য কোনো নারীকে দেখতে পেয়েছিলেন?

স্বরূপা বেগম : বাজারের কাছ থেকে জাহারা নামের এক যুবতী মহিলাকে ধরে নিয়ে অনেক অত্যাচার করছে। সে অবিবাহিত ও ম্যাট্রিক পাস ছিল।

বাশার খান : আপনাকে অত্যাচার করল জন্তুরা। তার পর...

স্বরূপা বেগম : না, হ (দীর্ঘশ্বাস, কান্না)। একসময় মেজর দরজা খুলে। তখন আমি দৌড় দিই।

বাশার খান : পত্রপত্রিকায় পড়েছি, আপনাকে উদ্ধারের জন্য নাকি মুক্তিযোদ্ধারা থানায় আক্রমণ করেছিল?

স্বরূপা বেগম : না, মুক্তিরা পাঞ্জাবিদের কারণে থানায় যেতে পারত না।কোনো আক্রমণও করে নাই মুক্তিরা। ওখানে তো আমার নিজের মানুষ ছিল না। শুধু পাঞ্জাবিরা। তাই আমি দৌড় দিই। আমি দৌড়ে চৌদ্দগ্রাম বাজার পর্যন্ত আসছি। পরে পাকবাহিনী পেছন পেছন আসে।

বাশার খান : গুলিবিদ্ধ হলেন কখন?

স্বরূপা বেগম : পেছন পেছন যহন আসছে, তহনই গুলি করে। পরে মুক্তিবাহিনী আমারে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যায়। আমাকে হাসপাতালে রেখে তারা চলে আসে। হাসপাতালে নারী-পুরুষসহ অনেকেই ছিল। সন্দেষকড়া গ্রামের এক পরিবারের সবাই আহত হইছে। হাসপাতালে এক সপ্তাহ পরে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার একটা পা নাই। 

বাশার খান : হাসপাতালে স্বজনদের কেউ গিয়েছিল?

স্বরূপা বেগম : সেখানে নার্সরা ওষুধ, খাবার-দাবার দিত। এক পোশাকেই হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। খবর শুইনা আমার মা আমাকে দেখতে গেছিল। স্বাধীনের পর আমার ভাই আমাকে নিয়ে আসে। বাজারের কাছ থেকে আমার মা কোলে করে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।

বাশার খান : দেশ স্বাধীন হলে যুদ্ধাহত বীরাঙ্গনা হিসেবে কোনো সুযোগ-সুবিধা বা সহায়তা পেয়েছিলেন?

স্বরূপা বেগম : না, এক মামা আমাকে ঢাকা নিয়ে পা লাগাইয়া দেয়।

বাশার খান : পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। এরপর কত সরকারই এলো-গেল। তখনো কোনো সহায়তা পাননি?

স্বরূপা বেগম : পরে জিয়াউর রহমান-এরশাদ এঁদের সময় কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই নাই। আগে-পরে কোথাও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই নাই, এলাকার কোনো মুক্তিযোদ্ধা, ইউনো (ইউএনও), পৌরসভা মেয়র, এমপি কেউ কোনো দিন কোনো খোঁজখবর নেয় নাই। 

বাশার খান : যুদ্ধাহত বীরাঙ্গনা হিসেবে সমাজের লোকেরা বিষয়টা কীভাবে নিত?

স্বরূপা বেগম : দেশে আসার পর আত্মীয়স্বজন সবাইকে বললে, তারা কেউ আসে না। তাদের নাকি লজ্জা লাগে। বীরাঙ্গনা বলে আমাকে লজ্জা দেয়। পরে পাঁচড়া গ্রামের কবির নামের এক কৃষকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আমার কৃত্রিম পা বিয়ের আগেই লাগানো ছিল। 

বাশার খান : আপনি বীরাঙ্গনা—এটা আপনার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানত?

স্বরূপা বেগম : শ্বশুরবাড়ির লোকজন শুধু জানত, যুদ্ধের সময় পা গেছে। বীরাঙ্গনা জানত না।

বাশার খান : স্বামীও জানত না?

স্বরূপা বেগম : পরে তো সব শুনছে-জানছে (দীর্ঘশ্বাস, কান্না)। শ্বশুর-শাশুড়ি অত্যাচার করত না। শুধু স্বামী অত্যাচার করত। বিয়ের দুই বছর পর স্বামী তালাক দেয়। একটা মেয়ে হয়েছিল মৃত। তালাক দেওয়ার পর বাড়িতে চলে আসি। 

বাশার খান : এর পর আপনার জীবিকা চলত কী করে?

স্বরূপা বেগম : এলাকার মানুষ দুই ঈদে সাহায্য করত। তাই দিয়ে চলতাম। ফিতরা-টিতরা আর কী।