নেকড়ে ও শিয়ালের রাজনীতি
কয়েক বছর আগে চীনের এক উচ্চপদস্থ কূটনীতিককে জিজ্ঞেস করা হয়, নিরাপত্তা বিষয়ে ভারতের দিক থেকে তাঁদের কোনো ঝুঁকি আছে কিনা? জবাবে কূটনীতিক বলেছিলেন, নেকড়ে যখন সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তখন পেছনের দরজায় দাঁড়ানো শিয়ালকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই! ইঙ্গিতে চীনা কূটনীতিক যুক্তরাষ্ট্রকে ‘নেকড়ে’ এবং ভারতকে ‘শিয়াল’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
এবার যখন নেকড়ে আর শিয়াল একসাথে হয়ে গেল তখন কিন্তু চীনের কাছে ব্যাপারটা একটু ভাবনার বিষয়ই। এক দশক ধরে ভারতের ওপর ভর করে চীনকে বাণিজ্যিক এবং সামরিক দিক থেকে চাপে রাখার অনেক চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতের বৃহৎ এবং বর্ধনশীল অর্থনীতিকে যুক্তরাষ্ট্র ঠিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তা চীনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ভারত নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে বেশ সচেতন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা এবং বেসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা পেয়েছে তারা। দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি ও অস্ত্র খাতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের পদ পেতে ভারতকে সমর্থনও দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি পর্যন্ত সবই কিনছে ভারত। সেই সাথে ভারতে বিনিয়োগের জন্য মার্কিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওবামা সরকারের তরফ থেকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
ওবামার এবারকার সফরে নরেন্দ্র মোদি এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, চীনের বিরুদ্ধে যাওয়ার বাসনা ভারতের রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দক্ষিণ চীন সাগরে যৌথ সামুদ্রিক নিরাপত্তা চুক্তির ব্যাপারে তারা আগ্রহী। আগ বাড়িয়ে মোদি আবার চতুর্ভুজ নিরাপত্তাবলয়ের কথাও তুলেছেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই বলয়।
চীন অবশ্য ভারতের এসব বাসনাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। চীনা রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ভারত ও চীনের মধ্যে যেসব বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা হালকা কোনো বিষয় নয়। সে জন্য এগুলো দু-একদিনের মধ্যে সমাধান করাও অসম্ভব।
অন্যদিকে চীনকে ঘিরে নিজস্ব প্রভাববলয় তৈরিতে ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। জাপান, চীন, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে সামরিক চুক্তি তাদের রয়েছে। এর পাশাপাশি ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সাথেও সামরিক সখ্য গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। যাতে করে চীনের সাথে মিয়ানমারের সামরিক বোঝাপড়াকে হুমকিতে রাখা যায়। একই সাথে ভারতের শর্ত মেনে বিরোধ মেটাতে পাকিস্তানকেও পরামর্শমূলক নির্দেশ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন আশকারা পেয়ে চীনের প্রতি ভারতের মনোভাবেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পেয়ে চীনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মনোভাব তৈরি হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে। আর সে কারণেই গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের সময় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের সময় চীন-ভারত সীমান্তে একটি অপ্রীতিকর ঘটনার কথা তুলে চীনা প্রেসিডেন্টকে যথেষ্ট বিব্রত করেছিলেন মোদি।
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব যেন সীমিত থাকে সে জন্য সজাগ রয়েছে ভারত। চীনের সাথে যুক্ত হওয়ার যে ইচ্ছা নেপালের রয়েছে, তাতে বরাবর বিরোধিতা করে আসছে ভারত। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ভারতের অবরোধের হুমকির মুখে রয়েছে নেপাল। শ্রীলঙ্কায় তামিল যোদ্ধাদের দমনে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে সম্প্রতি নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়েছেন। নির্বাচনে তাঁর পরাজয়ের পেছনে ভারতীয় সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের সমর্থন পেয়েই রাজাপাকসের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন একসময়ে রাজাপাকসের মন্ত্রী মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।
পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান, টিটিপি এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে চলেছে ভারত। এদের মধ্যে টিটিপি মূলত পাকিস্তানের চীনা সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলোতে সক্রিয়। আর বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি কাজ করছে পাক-আফগান সীমান্তে। তাদের কাজ হচ্ছে আফগানিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের প্রভাব কমিয়ে আনা। কারণ আফগানিস্তানে এখনো এক লাখের মতো মার্কিন সেনা কাজ করছে। সেখানে মার্কিন স্বার্থরক্ষায় সক্রিয় ভারত।
তবে চীন যে মুখ বন্ধ করে থাকবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। দেরিতে হলেও ইন্দো-মার্কিন সখ্যের শক্ত জবাব দেবে চীন। চীনের মূল শক্তি হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের বিস্তৃত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতেও চীনের জোরালো অবস্থান রয়েছে। চীনকে বাদ দিতে গেলে এদের সবাইকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।
চীন মূলত এখন রাশিয়ার সাথে তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করবে। পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন অবরোধ সামাল দিতে হচ্ছে রাশিয়াকে। নিজেদের অর্থনীতি দ্রুত গুছিয়ে নিতে চাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তাই পাকিস্তান ও ইরানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে রাশিয়া আন্তরিক। কারণ তাদের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তানকেও নতুন এই মেরুকরণের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে চীন, রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় নিজেদের পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে পাকিস্তান। তাহলে আফগানিস্তানকে ভারতের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা যাবে এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। মধ্য এশিয়াতেও পাকিস্তানের বন্ধুত্বের বৃত্ত বিস্তৃত হতে পারে।
এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো মিত্র হতে পারে চীন। চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক আগে থেকেই পরীক্ষিত ও সফল। এর বিপরীতে ইন্দো-মার্কিন সম্পর্ক অনেকটাই নতুন ও অপরিপক্ব। ভারতকে সামলে রাখতে হলে পাকিস্তানের সামরিক ও পারমাণবিক শক্তি দরকার হবে চীনের। আর দুই পক্ষেরই লাভ যেখানে রয়েছে সেখানে সুসম্পর্ক নবায়ন করে নেওয়াটা কঠিন কিছু হবে না।
মুনির আকরাম : জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালের আগস্টে পদত্যাগ করেন মুনির। এরপর গর্নতাজি গ্রুপ লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্য ও চীনে বিনিয়োগ ও আর্থিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।
কলামটি গত পয়লা ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়। ভাষান্তর করেছেন ফাহিম ইবনে সারওয়ার।