আন্তর্জাতিক

কাশ্মীরের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী ও সম্ভাবনা

Looks like you've blocked notifications!

৫৬ বছর বয়সী মেহবুবা মুফতি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসে যোগদানের মধ্য দিয়ে। দল পরিবর্তন করে বিশ বছরের মাথায় তিনি এখন রাজ্যের কর্ণধার। সম্প্রতি ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন বিখ্যাত মুফতি পরিবারের মেয়ে একসময়কার সমাজসেবিকা মেহবুবা মুফতি সাইদ। খানিকটা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া রাজনৈতিক জীবনে তিনি এখন পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান। তাঁর বাবা পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাইদ। 

কিছু দিন আগে ৭ জানুয়ারি মুফতি সাইদের আকস্মিক মৃত্যুতে জম্মু-কাশ্মীরে নতুন করে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। মৃত্যুর পর মুফতি মোহাম্মদ সাইদের গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগের বিজবেহারায় তাঁকে দাফন করা হয়। শেষ জীবনে প্রয়াত এই নেতা স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে যান। সবার ধারণা ছিল তাঁদের মধ্য থেকে এবার মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন দলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ সাইদের মেয়ে মেহবুবা মুফতি। কিন্তু সংশয় দেখা দিল অন্য জায়গায়। বিজেপির সঙ্গে গড়া কোয়ালিশন সরকারের চুক্তিগুলো যথাযথভাবে সম্পাদন হচ্ছে না এমন এক অভিযোগে শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন মেহবুবা মুফতি। সেই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করে বিজেপি। 

ওই সময় বিধানসভা না ভেঙে রাজ্যে রাজ্যপালের শাসন জারি করা হয়। তখন থেকে রাজ্যে অচলাবস্থার শুরু। তার বাবা মুফতির মৃত্যুর পর মেহবুবা বুঝতে পারেন, বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোয় পিডিপির জনপ্রিয়তা কমেছে। এতে সরকার গঠনে তিনি টালবাহানা করতে থাকেন। বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠনে মেহবুবার ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু তখন তিনি প্রয়াত বাবার ইচ্ছা ও চাহিদার বিরোধিতা করতে পারেননি। পরবর্তীকালে গত মাসের ২৩ মার্চ  মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর সম্পর্কের বরফ গলে। ওই বৈঠকের পর  উভয় পক্ষ আবারও একজোট হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় একটি চুক্তিও হয়। তবে চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। 

বিজেপির পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়, রাজ্যের জন্য নতুন করে কোনো প্রতিশ্রুতি তারা দিচ্ছে না। জোট সরকার গঠনের সময় মুফতি-মোদির মধ্যে যে বোঝাপড়া হয়েছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। তাহলে নতুন করে চুক্তি কেন? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।

এরপর রাজ্যে পিডিপি-বিজেপি জোট সরকার গঠন এবং সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মেহবুবাকে আমন্ত্রণ জানায় রাজ্যপাল। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে রাজ্যে প্রায় তিন মাস ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটল। তাঁর শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারতে মোট নারী মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল ৫।

এখানে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, মেহবুবাকে পিডিপি ও জোট উভয় পক্ষ থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মুসলিমপ্রধান পিডিপির সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির জোট টিকে থাকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। 

মেহবুবা সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, রাজ্যে তাঁর সরকারের লক্ষ্য হবে শান্তি, ঐক্য ও উন্নয়ন। এটি একটি জোট সরকার। এখানে পৃথক করে কারো অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া দপ্তর বণ্টনে পিডিপি ও বিজেপির মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন এ সময়।
উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতি করতে এলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমতি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলে খ্যাতি আছে মেহবুবা মুফতির। সম্প্রতি কাশ্মীরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও পিডিপির মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে সেটাতেও এটা লক্ষ করা যায়। মোদি সরকারকে বেশ চাপে রেখে দুই দলের সমন্বয়ে কাশ্মীরে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে। এই কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্বের চাবিকাঠি তুলে রেখেছেন মেহবুবা মুফতি নিজের হাতে। 

কাশ্মীরে বর্তমানে পিডিপি বেশ জোরালো অবস্থানে রয়েছে। আর দলের এই অবস্থানের পেছনে তাঁর প্রয়াত বাবার পাশাপাশি ৫৬ বছর বয়সী মেহবুবার বেশ অবদান রয়েছে বলে মনে করেন তাঁর দলের অধিকাংশ নেতা। সবশেষ নির্বাচনে ৮৭ আসনের জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় পিডিপির ২৭ জন ও বিজেপির ২৫ জন সদস্য নির্বাচিত হন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কেউই এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। সবশেষ ১১ সপ্তাহের  অচলাবস্থা কাটিয়ে মেহবুবার সঙ্গে সরকারের ২৩ মন্ত্রীও শপথ নেন এদিন। তবে শপথ অনুষ্ঠানে বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা অংশ নিলেও শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করে কংগ্রেস। এখানে রাজনীতির আলাদা মেরুকরণ হতে পারে। যে কংগ্রেস দিয়ে মেহবুবার রাজনৈতিক জীবন শুরু, তাঁরই শপথ অনুষ্ঠানে যায়নি কংগ্রেস! হতে পারে বিজেপির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য কংগ্রেসের এ অবস্থান। কিন্তু যেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কোনো দল, কোয়ালিশন সরকারের এ পদ্ধতিতে না যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল কি? কংগ্রেসের এ অনুষ্ঠান বর্জনে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে কংগ্রেস মেহবুবাকে সহযোগিতা করবে না।

ভারতের রাজনীতিতে জম্মু-কাশ্মীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এবং প্রায়ই এ স্থানটি আলোচনার বিষয় বস্তু হিসেবে চলে আসে। এদিকে পিডিপিরও অনেকেই চায়নি তার সরকার বিজেপির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে বসুক। মেহবুবা নিজেও চাননি একসময়। বেশ সময়ও নিলেন দ্বিতীয়বার সরকার গঠনে। কিন্তু শেষমেশ তিনি বাবার পথে হাঁটলেন এবং শপথ নিলেন। যদি তিনি তাঁর দলকে ঠিকমতো বোঝাতে ব্যর্থ হন এবং কংগ্রেস যদি অতি মাত্রায় অসহযোগিতা করতে থাকে, তাহলে এটা বিপদের কারণ হতে পারে জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম এবং সমগ্র ভারতের দ্বিতীয় মুসলিম নারী রাজ্যপ্রধানের জন্য। এর আগে ১৯৮০ সালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ারা তৈমুর (১৯৮০-১৯৮১) শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম নারী মুখ্যমন্ত্রী।

মেহবুবা মুফতি ২০০৯ সালে পিডিপির প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি একজন সমাজসেবক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। পেশায় আইনজীবী। তিনি প্রথম রাজনৈতিকভাবে আলোচনায় আসেন ১৯৯৬ সালে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অ্যাসেম্বলি পোলে বিজবেহারা অঞ্চলের সদস্য হয়ে। ১৯৯৯ সালে বাবা মুফতি মোহাম্মদ সাইদ কংগ্রেস থেকে বের হয়ে পিডিপি গঠন করলে মেহবুবা দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এবং নিজের অবস্থান গঠনে ব্যাপক কাজ করেন। সে বছরই সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ওমর আবদুল্লাহর কাছে হেরে যান। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে অ্যাসেম্বলি সদস্য হন। এবং ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে পহলগাঁও নির্বাচনে জয়ী হয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় একই নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।

নানা কারণে জম্মু-কাশ্মীরে মুফতি পরিবার বেশ আলোচিত। বিভিন্ন সময়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে পরিবারটি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক পরিবার হিসেবে সুনামও রয়েছে। মুফতি সাইদ সক্ষম থাকা সত্ত্বেও নবীনদের মাঝে দলের দায়িত্ব হস্তান্তর; দলে ও সাধারণ মানুষের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মুফতি পরিবার প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৮৯ সালে ভারতের নিষিদ্ধ সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের হাতে মুফতি সাইদের আরেক মেয়ে রুবাইয়ার জিম্মি হওয়ার মধ্য দিয়ে। সংগঠনের তিনজন বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে রুবাইয়া ছাড়া পান। রুবাইয়া জিম্মি হওয়ার পাঁচদিন পর মুফতি সাইদ রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তখন রুবাইয়াকেই ভবিষ্যৎ রাজনীতিক মনে করা হলেও মেহবুবাই নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন স্বীয় যোগ্যতায়।

রাজনীতিতে এসে ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের উদ্যোগ তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। রাজনীতিক হয়েও সমাজসেবক পরিচয় ধরে রাখা তাঁকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন অনেক পদক্ষেপ। এতে প্রত্যাশা বেড়েছে জনগণের। বিজেপির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন কোয়ালিশন সরকার গঠনের মাধ্যমে। কংগ্রেসকে বাগে এনে মিলেমিশে কাজ করতে পারলে ভারত যে আগামীর এক সম্ভাবনাময় নারী নেতৃত্ব পেতে যাচ্ছে, সেটা বলতেই হবে। যে দেশে মমতার মতো নেত্রীর জন্ম হয়েছে, সেখানে এ রকম কিছু একটা আশা করাই যায়। কাশ্মীরের জনগণও বোধ হয় সেটাই চাইছে। তাঁর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর কাছেও বোধ হয় জম্মু-কাশ্মীরবাসী এমন কিছু আশা করবে। সম্ভব হলে আরো বড় কিছু। সম্প্রতি কাশ্মীরের বন্যা পরিস্থিতিতেও তাঁর ব্যাপক উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। কাশ্মীরবাসী তাঁকে ঘিরে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। দেখা যাক তিনি কতটা সফল হন। সবকিছু সময়ই বলে দেবে।

লেখক : সাংবাদিক, দ্য ডেইলি সানের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি।