নারী নির্যাতন

সব তনু ঘুরে দাঁড়াক

Looks like you've blocked notifications!

‘মার খাব! মরে যাব!’ নারীদের জগৎটা কিন্তু এভাবেই যাচ্ছে। মার দিতে পারছি কয়জন! বা পারলেও কী দিচ্ছি! তনুর প্রোফাইল ঘেঁটে একটা নিউজ খুব ভাইরাল হয়েছিল, একটা বিশেষ নম্বর থেকে তাঁকে জ্বালানো হচ্ছে। আমাদের টেলিমনিটরিং সার্ভিস এতটা শক্তিশালী হয়নি যে সেই নম্বরের পেছনের ব্যক্তিকে ধরতে পারে! আমাদের ব্যর্থতা এখানেই!

এমনটা বলছি না, তনুর মৃত্যুর সঙ্গে ওই নম্বরের যোগ আছে! বলছি বেঁচে থাকার সময়ও তনু ঠিক সুস্থ জীবন কাটায়নি। তাঁকে লড়ে যেতে হয়েছিল হয়রানির বিরুদ্ধে! অতিষ্ঠ হয়ে ফেসবুকে সে পোস্টও দিয়েছে। তার পর তো এক বছর পর তনুই চলে গেল! লোকে মাতম করল ‘আমার বোন, আমার বোন’ করে। কিন্তু মাত্র গতকালেই হবিগঞ্জের বানিয়াচং এলাকায় এক গৃহবধূ ধর্ষণের বিচার চাইতে গেলে স্বামীকে বেঁধে পুনরায় ধর্ষণ করা হয় ওই গৃহবধূকে। সেটার বিচার শেষ অবধি কী হয়েছে, জানা নেই! ধর্ষক স্থানীয় নেতার ভাই। কতটুকু বিচার পাওয়া যাবে সেটার সম্পর্কে সন্দিহান! পত্রিকার পাতাও চুপচাপ! 

এটাই হচ্ছে আমাদের একটা বিশাল ভুল! তনুর প্রতিবাদে সমাবেশে আমাকে যেতে বলা হলে আমি বলি, তনুসহ ২০১৬ সালে মোট ধর্ষণ হয়েছেন ৫৮ জন নারী (২০ মার্চ পর্যন্ত পরিসংখ্যান)।  বাকি ৫৭ নারীর ক্ষেত্রে এই একই প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল, তাই না? আমাকে বলা হয়েছিল, ‘এক তনুর প্রতিবাদ হচ্ছে, সব তনুর জন্য হবে।’ আমি সত্যিই সে রকমটাই আশা করেছিলাম।

কিন্তু তনুরই তো ঠিকমতো বিচার হলো না? এখন পর্যন্ত ধরা পড়ল না তাঁর খুনি! 

তাঁকে খুন যে করা হয়েছে, তাঁর চেয়ে বড় খবর হয়ে গেল তাঁকে ধর্ষণ করা হয়নি! এবং এই খবর প্রমাণ করতে দুবার লাশের পরীক্ষা করতে হলো। থ্রিলার ড্রামা বা মুভি দেখে আমরা জানি, ফরেনসিক রিপোর্টে স্পার্ম, থুতুর সোয়াব ইত্যাদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নির্ধারণ করতে হয় রেপ ভিকটিমের ক্ষেত্রে। এবং সেই ফরেনসিক রিপোর্টে তনুর ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। ১০ দিন পর পুনরায় কবর থেকে ওঠানো দেহে সেই আলামতগুলো পাওয়া কি সম্ভব? কারণ, কবর দেওয়ার আগে তাঁকে গোসল করানোর সময় সেই আলামত কি মুছে যায়নি? তাহলে দ্বিতীয়বার ফরেনসিক রিপোর্টের আর কী মূল্য আছে? 

আচ্ছা ধরে নিলাম, ১০ দিন পরও ফরেনসিক রিপোর্ট সত্য কথা বলে! সেই সত্য কথায় এলো, ‘তনু ধর্ষিত হয়নি!’ প্রতিবাদ ঝিমিয়ে গেল। যারা ‘আমার বোন, আমার বোন’ বলে রব তুলেছিল, তারা কিছুক্ষণ ছি ছি করে বলল, ‘ধর্ষিত না হয়েও মেয়েটার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করা হলো!’  কিন্তু মেয়েটা যে খুন হলো, সে নিয়ে আর কথা বাড়াল না কেউই!

প্রতিটি ধর্ষণের পরপর মেয়েদের পোশাক নিয়ে দোষ দিতে দিতে, যখন তনুর মৃত্যু থাপড় দিচ্ছিল সবাইকে, ‘পোশাক কোনো ফ্যাক্টর না’, ঠিক তখনই তনু ‘বোন’ হয়ে উঠেছিল। 

এই যে প্রতিবাদ সরব থেকে নীরব হওয়া! এই একই কাজগুলো হয়েছিল সিমির মৃত্যুর সময়। সিমির বাবাকে করতে হয়েছিল ৬০টা জিডি। কিংবা বখাটেদের লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে ফ্যানে ঝুলে হত্যা করে রুমির ক্ষেত্রেও হারিয়ে গিয়েছিল সেই প্রতিবাদ! আর পূর্ণিমা শীলকে তো নিজেই দেখেছি। আজ ২৮ বছর বয়সেও লড়াই করে যাচ্ছে নিজের ওপর সংঘটিত পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে। পূর্ণিমার একটা কথা বাজে কানে, ‘তিনতলার ঘরেও সুখ পাইল না রে পূর্ণিমা।’ আচ্ছা, এতদিনে এই একটারও কি ঠিক বিচার হয়েছে? এটা কি সরকারের ব্যর্থতা না? তনু তো শুধু একটা সংযোজন! আর কিছু না।  

অত কিছু বুঝি না! যতদিন বেঁচে আছি, মার খাব না! আমি জানি, আমি প্রতিদিনই রেপের শিকার হই! পুরুষের চোখ, মুখ, হাত দ্বারা! দৈনন্দিন এ ছোট্ট ছোট্ট রেপের প্রতিবাদ করতে আমি শিখে গেছি।

আমি করব! কারণ মরার পরে আমি কিছু মূর্খর পোস্টমর্টেমের শিকার হতে চাই না! সব তনু রুখে দাঁড়াক। প্রীতিলতা ব্রিগেড সংগঠন মেয়েদের তায়াকোয়ান্দো শেখাচ্ছে। এভাবেই আত্মরক্ষা শিখব আমরা। আমাদের মারতে এলে আমরাও আক্রমণ করব। আমরা আমাদের সেপটিপিন, চুলের কাটা, নেইল কাটার দিয়ে যুদ্ধ করব! আমরা পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে লড়াই করব! কিন্তু করব! আমাদের পাশে কেউ নেই! লড়াইটা আমাদের নিজেদের!

একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি, মেয়েদের তায়াকোয়ান্দো শেখানো হচ্ছে এমন খবরের নিচে বহু ছেলেদের কমেন্ট, ‘মেয়েরা যতই কিছু করুক, ছেলেদের সাথে পারবে না।’ এই পারবে না কথাটার মানে ছেলেগুলো ভয় পেয়েছে! মেয়েরা যখন পারবে, তখন এদের চোখ খুলে যাবে! এই সামান্য হীন কথাটা বলতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। 

আমি চাই না, আর কোনো তনুর এভাবে মৃত্যু হোক! এক তনুর মৃত্যু দিয়ে বাকি তনুরা বুঝুক, এই পৃথিবীতে তাঁদের একাই প্রতিবাদ করে যেতে হবে। সে রাস্তায় সরকার নেই, বন্ধু নেই, পরিবার নেই! মেয়ে খালি একা! একলার সেই প্রতিবাদটা শুরু করতে হবে এখনই!

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, ফেমিনিজম বাংলা।