প্রত্নতত্ত্ব
উজালপুরে হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস
প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশের সব জেলার মাঝে নওগাঁ জেলার অবস্থান অনন্য। প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যে ভরপুর নওগাঁ জেলায় রয়েছে অন্তত ১২০০ বছরের প্রাচীন স্থাপনা। আরো আছে মধ্যযুগ ও ঔপনিবেশিক আমলের অজস্র নিদর্শন।
১২০০ বছর আগে পাল রাজবংশের আমলে সমগ্র নওগাঁ অঞ্চল ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক রাজধানী। পাল রাজাদের আদিভূমি ছিল বরেন্দ্র অঞ্চল, আর বর্তমান নওগাঁ জেলা সেই বরেন্দ্র ভূমির প্রাণকেন্দ্র।
বদলগাছী উপজেলার বিশ্ব ঐতিহ্য সোমপুর বৌদ্ধবিহার, হলুদ বিহার, ধামুইরহাট উপজেলার জগদ্দল মহাবিহার ও আলতাদিঘি, পত্নীতলা উপজেলার ধীবর স্তম্ভ, অগ্রাদ্বিগুণ, মান্দা উপজেলার কুসুম্বা মসজিদ, আত্রাই উপজেলার পতিসর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি প্রভৃতি এই জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ও দর্শনীয় স্থান।
শুরুটা হয় যেভাবে
২০১৩ সালে নিমফিয়া পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় Buddhist Heritage of Bangladesh নামক একটি বই। সেই বইয়ের দুটি অধ্যায় লেখেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক মোহাম্মদ আবু আল হাসান। আর সেই অধ্যায় দুটি লেখার ও সংশ্লিষ্ট ছবি সংগ্রহের কারণে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হয় হাসানকে। সেই সূত্রেই নওগাঁ জেলার বিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান তরুণ এই গবেষক।
হাসান বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা জাদুঘরের গাইড (সহকারী পরিচালক) হিসেবে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে পিএইচডি করছেন তিনি।
এ সময় তিনি লক্ষ করেন ব্রিটিশ শাসনামলে বুখানন হ্যামিল্টন হয়ে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দেশের সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন অনুসন্ধান ও গবেষণা পরিচালিত হলেও নওগাঁর রানীনগর ও আত্রাই উপজেলায় কোনো প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কারের লক্ষ্যে গত দুই বছর ধরে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়ে আসছেন হাসান।
তাঁর দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রথম সাফল্য আসে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। তিনি রানীনগর উপজেলার ৭নং একডালা ইউনিয়নে তিনটি এবং আত্রাই উপজেলার ৬নং মুনিয়ারী ইউনিয়নে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কার করেন।
স্থানগলো হলো ৭নং একডালা ইউনিয়নের উজালপুর গ্রামের ঈদগাহ ঢিপি, একই গ্রামের ঘোরাপাতা ঢিপি, রাজাপুর গ্রামের রাজাপুর ঢিপি এবং ৬নং মুনিয়ারী ইউনিয়নের দিঘিরপাড় দ্বীপ।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, এগুলো পাল রাজবংশের সময়ের কোনো ধর্মীয় স্থাপনা। স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে হাসান জানতে পারেন, উজালপুর গ্রামের ঈদগাহ ঢিপিটি যা বর্তমানে সমতল থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচু, মাত্র দুই বছর আগেও এটি প্রায় ১৭ ফুট উঁচু ছিল।
বছর দুয়েক আগে সরকারি কর্মসূচির আওতায় স্থানটির প্রায় পাঁচ ফুট মাটি কেটে সমতল করে গ্রামের ঈদগাহ করা হয় ও ঢিপিটির পূর্ব প্রান্তে মাদ্রাসার জন্য দুটি ঘর তোলা হয়।
সেই সময়েই হাসান জানতে পারেন যে, ২০১৬ সালের মার্চে পুনরায় সরকারি কর্মসূচির আওতায় ওই স্থানটির মাটি পুরোপুরি কেটে সমতল করে ফেলা হবে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ওই স্থানে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন প্রাপ্তির স্বার্থে আরো অনুসন্ধান চালান।
অনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হন স্থানটির মাটির নিচে বড় আকৃতির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন লুকিয়ে আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর প্রাচীনত্ব ও এর স্বরূপ উদঘাটনের লক্ষ্যে গবেষক হাসানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে তাঁকে উজালপুর গ্রামের ঈদগাহ ঢিপিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের অনুমতি দেয়।
সম্ভাব্যতা যাচাই ও ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক মোহাম্মদ আবু আল হাসান বড় আকারের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন চালানোর উদ্দেশ্যে স্থান শনাক্ত করার জন্য ঢিপিটির পূর্ব অংশে ছোট আকৃতির পরীক্ষামূলক ট্রেঞ্চ নিয়ে সেখানে মাটির এক ফুট নিচে আড়াই ফুট চওড়া একটি ইটের পিলার ও ছয় ফুট নিচে ইট দ্বারা নির্মিত মেঝের সন্ধান পান।
সে সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে হাসান বলেন, প্রাথমিকভাবে গ্রামবাসীর প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। উজালপুর গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই নিরক্ষর এমনকি গ্রামটিতে কোনো বিদ্যুৎ নেই, বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই রয়েছে ধর্মীয় গোড়ামি। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। সে কারণে খননকৃত স্থানটি ঈদগাহ হওয়ায় এবং তার পাশেই মাদ্রাসা থাকায় গ্রামের জনসাধারণ এই ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাদের অনেক বোঝানোর পরেও তারা আশ্বস্ত হতে না পেরে উৎখনন প্রক্রিয়া বন্ধ ও আমাকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে শুরু করে।
হাসান আরো বলেন, এ অবস্থায় কোনো উপায়ন্তর না দেখে রানীনগর উপজেলার ইউএনও ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে নিরাপত্তা ও সহযোগিতার জন্য আবেদন করি। রানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ এতে সাড়া দেন। এ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহসান, সহযোগী অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ, বুয়েটের ম্যাটেরিয়াল ও মেটালজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আসও কারনী ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক ও বিখ্যাত পুরত্নত্ত্ববিদ শাহনাজ হুসনে জাহান আমাকে উৎসাহ দেন।
হাসান বলেন, গ্রামবাসীর বাধার মুখে কাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। সে সময় কোনো উপায়ন্তর না দেখে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদারের সহায়তায় ওই এলাকার সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করি। স্থানটি ঈদগাহ শুনে প্রথমে তিনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও গবেষণা কাজটির গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি আমাকে সব রকম সহায়তার আশ্বাস দেন এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে স্বয়ং উপস্থিত থেকে সব রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। সংসদ সদস্যের আশ্বাস পাওয়ার পর গত ১০ এপ্রিল থেকে পুলিশি নিরাপত্তায় ঈদগাহ ঢিপিতে উৎখনন শুরু করি।
সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে ও অর্থায়নে এত ঝুঁকি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসান জানান, ‘অবহেলা, অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেখানে চোখের সামনে এত বড় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যাবে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে তা মেনে নিতে পারিনি। সাহস করে এগিয়ে না এলে এতদিনে হয়তো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে সমতল মাঠ বানিয়ে ফেলা হতো।
উৎখনন শুরু ও প্রাচীন স্থাপনার উন্মোচন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের সান্নিধ্যে উয়ারী-বটেশ্বরে কাজ করার সুবাদে উৎখননের প্রশিক্ষণ পান হাসান।
সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গত ১০ এপ্রিল থেকে উৎখনন শুরু করেন তিনি। তাঁর উৎখনন দলে ছিলেন উজালপুর গ্রামের দুজন শিক্ষিত যুবক ফিরোজ আলম রাজীব ও ওসমান গনি। সঙ্গে আরো ছিলেন নজরুল ও সিদ্দিক নামে দুজন শ্রমিক। উৎখনন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামোও উন্মোচিত হতে থাকে। অবশেষে ১৮ এপ্রিল স্থাপত্যটির কাঠামো আংশিক পরিষ্কার হতে শুরু করে। স্থাপত্যটির কাঠামো দেখে গবেষক হাসান অনুমান করেন, এটি সম্ভবত পাল আমলের (৭৫০-১১৫০) কোনো একসময়ের স্থাপনা অর্থাৎ স্থাপনাটি অন্ততপক্ষে হাজার বছরের প্রাচীন।
স্থাপত্যটির কাঠামো নকশা অনেকটা ক্রুসিফরম আকৃতির তার ভিত্তিতে তিনি এটিকে বৌদ্ধদের কোনো ধর্মীয় স্থাপনা বা জ্ঞানচর্চার স্থান হিসেবে ধারণা করছেন। তবে তিনি এও জানান যে, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয় হওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে বেশি কিছু বলার সুযোগ কম, তবে সামনের বছর থেকে নিয়মিত উৎখনন চালানো হলে এর ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে। এ কাজে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
হাসান জানান, গ্রামবাসী প্রথমে না বুঝে তাঁর কাজে বাধার সৃষ্টি করেছিলেন। তবে ধীরে ধীরে স্থাপত্য নিদর্শন উন্মোচিত হতে শুরু হওয়ায় গ্রামবাসী আগ্রহ ভরে প্রতিদিন তাঁদের কাজ দেখতে ছুটে এসেছেন। এখন সবাই আনন্দিত যে সম্পূর্ণ স্থাপত্যটি উন্মোচিত হলে তাঁদের গ্রামে হয়তো পর্যটনের বিকাশ ঘটবে, বিভিন্ন স্থানের মানুষ আসবে তাঁদের গ্রামে।
গত ২১ এপ্রিল এ বছরের মতো উৎখনন কার্যক্রম শেষ হলেও উৎখননে প্রাপ্য মাটির নমুনা ও কিছু মৃৎপাত্রের নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ চলবে সারা বছর, সেই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নেও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালাবেন বলে জানান হাসান।
সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য পেলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি আবারও উজালপুর গ্রামে পুনরায় উৎখনন শুরু করার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
লেখক : সাংবাদিক