ভাষা

মুস্তাফিজ, ওরাই বরং বাংলা শিখুক!

Looks like you've blocked notifications!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা, লেখালেখি বুঝতে ফরাসি কিংবদন্তি রোম্যাঁ রোল্যাঁ বাংলা শিখেছিলেন। এই তথ্য যেমন চমকপ্রদ, তেমনি আরেকটা চমকপ্রদ তথ্য হলো—পৃথিবীর মধুরতম (সুইটেস্ট) ভাষা লিখে গুগল করলে লেখা ওঠে বাংলা। ইউনেস্কো সেই স্বীকৃতি বাংলাকে দিয়েছে।

সবচেয়ে বেশি মানুষের ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে পৃথিবীতে বাংলার অবস্থান সপ্তম, ব্যবহারকারী ২০৫ মিলিয়ন মানুষ। এই মানুষরা শুধু দুই বাংলাতেই নন, আরো অন্যখানেও আছেন; ভারতেই আছেন পশ্চিমবঙ্গ-লাগোয়া কিছু অঞ্চলে। তবে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষার এ অবস্থান তৈরিতে সিংহভাগ কৃতিত্ব ও প্রয়াস দুই বাংলার; বিশেষত বাংলাদেশের।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে দুটি দেশ পেয়েছিলাম। ১৯০৫ সালের সূত্র মেনে ৪২ বছর পর বাংলাকেও দ্বিখণ্ডিত করা হলো। সাতচল্লিশ তাই আজও একটা রক্তক্ষরণ! মানচিত্র, পতাকা সবকিছুতে এলো ভিন্নতা। শুধু ভাষায় ভিন্নতা আনার শক্তি কারো হলো না।

পৃথিবীতে ভাষার বন্ধন ও গতিকে স্বৈরশক্তি দিয়ে আটকায় এমন ক্ষমতাবান কেউ এখনো জন্মায়নি!

ভাষা প্রসঙ্গে কথা বলার কারণ, এক বাঙালি তরুণের সাম্প্রতিক কৃতিত্ব। দুনিয়ার তামাম মিডিয়ায় সংবাদটা ভাইরাল হয়ে গেছে—বাংলা শিখছেন ভিভিএস লক্ষ্মণ, টম মুডি ও ডেভিড ওয়ার্নার! গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে তাঁরা বাংলা শব্দ ব্যবহার করছেন নিজেদের টুইটারে। শিখছেন বাংলা। নিজেদের প্রয়োজনে। মুস্তাফিজুর রহমান নামক একজন বাংলাভাষী তরুণের সঙ্গে সুন্দর-স্বাভাবিক-নিষ্কণ্টক যোগাযোগের জন্য তারা এই পথ বেছে নিয়েছেন। শিখুন। হে ভিনদেশি, আপনারা প্রাণভরে বাংলা শিখুন। আপনাদের অভিবাদন।

সবাই জেনে গেছেন, বাংলা ছাড়া ইংরেজি-হিন্দি ভালোভাবে বুঝতে পারেন না বলে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলতে গিয়ে সতীর্থ-কোচদের সঙ্গে যোগাযোগে বেশ সমস্যা হচ্ছে মুস্তাফিজের। সাংকেতিক চিহ্ন ছাড়া অধিকাংশ কথা বোঝাতেই পারছেন না অন্যদের। কিন্তু যে সমস্যা মুস্তাফিজের, উপযাচক হয়ে সেই সমস্যার সমাধান কেন ওয়ার্নার-মুডিরা বের করতে গেলেন?

গভীরভাবে ভাবলে উত্তর একটাই—মুস্তাফিজ বোলিংয়ে তাঁদের সেরা অস্ত্র; সেই অস্ত্রের সঙ্গে ভাষিক যোগাযোগ তো রক্ষা করতে হবে! ও রকম বড় মানের খেলোয়াড় না হলে হয়তো ওরা বিষয়টি পাত্তাই দিত না। মুস্তাফিজের সঙ্গে সেটা করতে গেলে নিজেদেরই ক্ষতি, দলের ক্ষতি। অতএব, যে পথে মুস্তাফিজ চলেন, সেই পথে তাঁরাও চলেন!

চারদিকে যখন মুডি-লক্ষ্মণ-ওয়ার্নারদের বাংলা শেখার চেষ্টা নিয়ে চর্চা চলছে, তখন দৃশ্যপটে এলেন পাকিস্তানের রমিজ রাজা। পাকিস্তান সুপার লিগ চলার সময় ভাষা নিয়ে তামিম ইকবালকে কটাক্ষ করেছিলেন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সঞ্চালক রমিজ। আইপিএলে যখন মুস্তাফিজকে নিয়ে ব্যাপক চর্চা চলছে, ঠিক সে সময়েই সানরাইজার্স হায়দরাবাদের এই বোলার কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ম্যাচে এমন ৪-১-৯-২ অসাধারণ সব সংখ্যার জন্ম দিয়ে হলেন ম্যাচসেরা।

খবরে প্রকাশ, তাঁর জন্য দোভাষী নিয়োগ দিয়েছে হায়দরাবাদ ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্তৃপক্ষ। যদিও সেদিনের ম্যাচসেরা মুস্তাফিজের সঙ্গে আসতে দেখা গেল না কোনো দোভাষীকে। তাহলে রমিজের সঙ্গে মুস্তাফিজ কোন ভাষায় কথা বলবেন? হিন্দি বা উর্দু শুরু করে দেবেন না তো রমিজ! এই শঙ্কা তখন মনে। মুস্তাফিজেরও সেই শঙ্কা ছিল কি না কে জানে!

দুরুদুরু বুকেই বোধ হয় সঞ্চালক রমিজের দিকে এগিয়ে গেলেন কাটার-মাস্টার ও ফিজ নামে খ্যাতি পাওয়া মুস্তাফিজ। রমিজ ওই সময়ের মধ্যেই আর কোনো বিশেষণ না পেয়ে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ শব্দটাই ইংরেজিতে তিন-চারবার উচ্চারণ করে ফেললেন। এর পর তাহলে কী হবে?

নাহ, এবার আর ভুল করলেন না রমিজ। করমর্দন করে, সবাইকে বিস্মিত করে মুস্তাফিজের হাতে মাইক্রোফোন এগিয়ে বাংলায় কিছু বলার অনুরোধ করলেন। মুস্তাফিজ বললেন, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আজকের গেমটা অনেক ভালো হয়েছে। সবাই খুব এনজয় করেছে। থ্যাংক ইউ। তার পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজপুত্র হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ক্যামেরার লেন্স থেকে।

৩.

লেখার এ পর্যায়ে এসে আমরা মুস্তাফিজ প্রসঙ্গটাতে একটু ক্ষান্ত দিই। প্রাসঙ্গিক স্থানে আমরা আবারও ফিরে আসব তাঁর প্রসঙ্গে। আমরা একটু অন্যদিকে, ইতিহাসের দিকে পরিভ্রমণ করে আসতে চাই।

একদিন ব্রিটিশরা আমাদের ইংরেজি শিখিয়েছিল। ইয়েস, নো, ওয়েল ভেরি মার্কা ইংরেজি ওরা আমাদের শিখিয়েছিল ওদেরই প্রয়োজনে। পেছন ফিরে সেই ইতিহাসের দিকে তাকালে হাসি পায়। তবে এ দেশে ইংরেজির বিকাশ এবং আজকের দিনে তার আধিপত্য বিস্তারী অবস্থান দেখলে আর মুখ হাস্যোজ্জ্বল থাকার জো নেই; বরং ইতিহাস মিলিয়ে পাঠ করার দায় আছে।

শোনা যাচ্ছে, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, বাংলা ক্লাস ছাড়া অন্য যেকোনো সময়ে স্কুলে কোনো শিক্ষার্থী বাংলায় কথা বললে তাকে নগদে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে। বিস্ময়কর! ভাগ্যিস, এদের পাঠ্যসূচিতে বাংলা নামক একটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে! ইংরেজির আধিপত্য বিস্তারের অবস্থানের কথা যে ওপরে লিখেছি, ঢাকার ওই স্কুলের বিজ্ঞপ্তি সেটারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ঢাকার উত্তরায়, আইইউবিএটি নাম। তাদের ক্যাম্পাসে বাংলা বলা নিষিদ্ধ!

সারা দুনিয়ায় একাডেমিকভাবে ইংরেজির এতটাই দাপট যে, দেশে দেশে মানুষের মনোজগতে ঘুমিয়ে থাকা উপনিবেশ তার দাসত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। পৃথিবীতে আর কোনো ভাষা নেই। বাংলাদেশেও নেই! এখানেও প্রমাণ করছে এরা—অনলি ইংলিশ ইজ রিয়েল!

কারো ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার একটা সহজ সূত্র আছে। সূত্রটা হলো, পুঁজির প্রলোভন; মানে, বৈষয়িক কার্যকরণ দেখানো। সেটা কেমন, দেখুন।

১৭৭৪ সালে কলকাতায় ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠা করে সুপ্রিম কোর্ট, এ অঞ্চলের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক আদালত। ঠিক এ সময়েই, আদালতের প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞানের উদ্ভব এখানে। আর এই কাজ চালানোর মতো প্রাথমিক জ্ঞান ছিল—ইয়েস নো ভেরি ওয়েল। প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ তাঁর বাংলার বিদ্বৎসমাজ গ্রন্থে বলেছেন :

আধাশিক্ষিত কয়েকজন ইউরোপীয়, এবং সুপ্রিম কোর্টের ব্রিটিশ অ্যাটর্নি ও উকিলদের কজন বাঙালি অবাঙালি উদ্যোগী দালাল—এরাই হলো আমাদের দেশের প্রথম প্রসিদ্ধ ও পূরিপূর্ণ ইংরেজি-বিদ্বান ও শিক্ষক।... এদের ইংরেজিবিদ্যার পুঁজি বলতে পকেট নোটবুকে টুকে রাখা কয়েক ডজন শব্দ। দেশের যেসব ভুঁইফোড় অভিজাতরা এদের কাছে ইংরেজি শিখতে আসত, তাদের শিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকত মুখস্থ করা কয়েকটি শব্দে। ইংরেজি ভাষায় যা তারা প্রকাশ করতে অক্ষম হতো, তা তারা প্রকাশ করত নানা রকম সংকেতচিহ্নের সাহায্যে।

কয়েক ডজন শব্দের মধ্যে ইয়েস, নো, ভেরি ওয়েল খুব বেশি পরিমাণে উচ্চারিত হতো। এভাবেই এ দেশে শুরু হলো ইংরেজি শিক্ষা। ইংরেজি আমাদের শিখতে হয়েছিল টুকটাক, নিজেদের প্রয়োজনে যেমন; তেমনি ওদের প্রয়োজনেও। ওরা ওদের প্রয়োজনে শিখিয়েছিল; কারণ ওদের এদেশীয় দালাল দরকার ছিল। আর আমরা নিজেদের প্রয়োজনে শিখেছিলাম, কারণ আমাদের ইংরেজ নামক প্রভুর পুঁজির সঙ্গে সংযোগ দরকার ছিল। তার চাকরি-কাঠামোয় আমাদের প্রবেশ দরকার ছিল। মানে, শেষ পর্যন্ত পেশাগত প্রয়োজনেই এখানে ইংরেজি শিক্ষার ভিত্তি হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজদের টোপটা বাঙালিরা তথা ভারতীয়রা ভালো গিলেছিল!

৪.

আজকে মুস্তাফিজ যেভাবে ওই যে গেম, এনজয় ও থ্যাংক ইউ শব্দগুলো বলছেন, এর চেয়েও খারাপ ছিল আমাদের আদিযুগের ইংরেজি শিক্ষা। মুস্তাফিজ এটা ভেবে নিশ্চয়ই তার বিব্রতবোধ দূর করতে পারেন। আমি জানি, আশাবাদী মানুষই হয়তো তাঁকে আত্মবিশ্বাস দিয়ে বলবেন, শুরুতে একটু-আধটু জড়তা থাকেই। পরে ঠিক হয়ে যাবে। মুস্তাফিজ আইপিএল শেষ করে বিশ্ববিখ্যাত কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে যাবেন। অনেকের আশা, হয়তো তার আগেই চালিয়ে নেওয়ার মতো ইংরেজি তিনি শিখে ফেলবেন।

কিন্তু আমার প্রশ্নটা হলো, এই ইংরেজি তাঁকে জোরপূর্বক শিখতে হবে কেন? সবার ভাবখানা এমন যেন ইংরেজি না শিখলে মাঠে মুস্তাফিজ বলকে তাঁর মনের ভাষায় কথা বলাতে পারবেন না!

আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝলাম যে ক্রিকেট খেলাটাকে ভদ্রলোকের খেলা তকমা দিয়ে ওরা এখানে ইংরেজি বলাটাকে আইন না হলেও একটা সংস্কৃতি (কালচার) বানিয়েছে। ক্রিকেট খেলাটাও এমন যে, এখানে প্রচুর ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। ফলে ক্রিকেট নিয়ে চলাফেরা, এমন একজনের কাছে আপনি চাইলেই ইংরেজি-বিযুক্ত কথাবার্তা শুনতে পাবেন না। উচিতও না চাওয়া।

বাংলাদেশ দলের সীমিত ওভার ক্রিকেটের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা আছে এ ব্যাপারে। এই তো গত ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলা ভাষার বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে। ক্রিকেটাররা যেহেতু দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেহেতু এখানে কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেন?

উত্তরে মাশরাফি বলেছিলেন, ক্রিকেটটা এমন একটা খেলা, যেখানে হয়তো ইংরেজির প্রয়োগটা খুব বেশি থাকে। তবে আমার কাছে মনে হয়, আমরা যাঁরা বাঙালি আছি, বাংলা ভাষাটা অবশ্যই আমাদের সবার ভেতরে থাকা উচিত। বাংলা ভাষাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত এবং আমরা যাঁরা খেলোয়াড় আছি, বাংলা ভাষায় কথা বলতে সব সময়ই পছন্দ করি। এটা খুবই স্বাভাবিক। আসলে যেটা বললাম, আমাদের খেলাটাই এমন, যেখানে হয়তো সারা দুনিয়ায় ইংরেজির প্রয়োগটাই বেশি থাকে। তার পরও আমরা যেখানেই থাকি, আমরা চাই বাংলা ভাষায় কথা বলতে এবং আমাদের প্রথম পছন্দ বাংলা ভাষা । (২৩/০২/২০১৬, পৃষ্ঠা-১০, দৈনিক সমকাল)

আশা করি, বিষয়টা এখানে পরিষ্কার করতে পেরেছি। মুস্তাফিজ প্রসঙ্গেও এ কথা প্রযোজ্য। মাতৃভাষায় স্বাচ্ছ্ন্দ্যবোধ কে না করে! কিন্তু আমরা তো আরো দূরে চোখ বিস্তৃত করতে চাই। আমরা চাই, ক্রিকেট খেলাটাও এমন একটা জায়গায় যাক, যেখানে ইংরেজি না বলার স্বাধীনতাও একজন ক্রিকেটারের থাকবে। আনুষ্ঠানিক পরিসরে তিনি যে ভাষায় কথা বলতে চাইবেন, তাঁকে সে ভাষায় কথা বলতে দেওয়া হবে।

এ জন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে সাম্যবাদী খেলাটার নাম ফুটবল। ফুটবল নিজেই যেন একটা ভাষা, জনপ্রিয়তার নিরিখে ফুটবলের ধারেকাছেও তো কোনো খেলা নেই। এই খেলায় কত বড় বড় কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে। পেলে, দিয়েগো ম্যারাডোনা, আলফ্রেড ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুসকাস, ইয়োহান ক্রুয়েফ, ফ্রেঞ্চ বেকেনবাওয়ার, জিনেদিন জিদান, রোনালদো। দূর দেশের এই তারাদের আমরা দেখেছি, শুনেছি মাতৃভাষায় কথা বলতে। হালের লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমারদের মাতৃভাষা স্প্যানিশ কিংবা পর্তুগিজ। যত বড় মঞ্চই হোক, তারা কিন্তু ঠিকই মাতৃভাষায় কথা বলেন।

হ্যাঁ, স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ বা ফরাসি বা ডাচ ভাষার মধ্যেও উপনিবেশের দাগ লেগে আছে। তবে তা এই আলোচনায় আমরা টানছি না। আমরা বলতে চাইছি, ইংরেজি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে এই ভাষাগুলো লড়াইয়ের ছোট ছোট পাটাতন হিসেবেও তো ব্যবহারযোগ্য হয়েছে। হচ্ছে।

এভাবেই হয়তো ইংরেজির হেজিমনি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। ইংরেজির এই মনোজগতে তৈরি করে রাখা উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে দুনিয়ায়। আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক লড়াইটাও জরুরি। ফুটবল কিংবা অন্যান্য খেলা এ ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। হয়তো সচেতন বা অবেচতনভাবে করছেও।

জার্মানরা ইংরেজি বলতে চায় না। ফরাসিরাও চায় না। এশিয়ায় জাপান বা চীনও সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ব্যাপারটা তাই অসম্ভব কিছু নয়। সবই সম্ভব। নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য সেই মাত্রার বৈশ্বিক সক্ষমতা তৈরি করতে পারলে, অন্য ভাষার আধিপত্যকে থোরাই তোয়াক্কা করা যায়।

ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের যোগটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যের গতিই তো ভাষাকে গতি দেয়, প্রাণ দেয়, জল দেয়, বায়ু দেয়। লড়াইটা তাই যেমন মুখের ভাষায় করতে হয়, তেমনি লেখার ভাষাতেও করতে হয়। সাহিত্যের ভাষা প্রশ্নে আফ্রিকার অসামান্য সাহিত্যিক, ফ্রাঞ্জ ফানোঁ স্কুলের অন্যতম সেরা ভাষ্যকার নগুগি ওয়া থিওঙ্গ তাঁর বিখ্যাত ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ গ্রন্থে লিখেছেন :

আমি বিশ্বাস করি কেনিয়ান ভাষা, আফ্রিকান ভাষা গিকুউয়ে আমার লেখালেখি কেনিয়া ও আফ্রিকার মানুষের আধিপত্যবাদী লড়াইয়ের অংশ। আমি চাই, কেনিয়ানরা ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতাকে ছাপিয়ে যাক। আমরা আফ্রিকান লেখকরা আমাদের ভাষার জন্য কাজ করতে বাধ্য, যা স্পেন্সার, মিল্টন ও শেকসপিয়র ইংরেজির জন্য করেছেন; পুশকিন ও তলস্তয় করেছেন রাশিয়ান ভাষার জন্য। প্রকৃতপক্ষে যা পৃথিবীর ইতিহাসের সব লেখক তাঁদের ভাষার জন্য করেছেন সাহিত্য সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে। এই প্রক্রিয়াই পরবর্তী সময়ে দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মানুষের সমস্ত সৃষ্টিশীলতার ভাষাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

এটাবেই নগুগি আমাদের আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াই এগিয়ে নেওয়ার পাঠ শেখান। জেমস নগুগি থেকে নগুগি ওয়া থিওঙ্গ নাম ধারণ করে শেখান কীভাবে ডিকনস্ট্রাক্ট করতে হয় চিন্তাকে। তিনিই তো সেই ব্যক্তি, যিনি সাহসী লেখনীতে একাডেমিকভাবে ইংরেজি বিভাগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

অন্যদিকে, উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ফ্রাঞ্জ ফানোঁ আমাদের দেখান, কীভাবে আমরা ভাষার বেড়াজালে আটকে পড়ে উপনিবেশেরই প্রতিনিধি হয়ে উঠি। ফানন তাঁর জগদ্বিখ্যাত ‘জগতের লাঞ্ছিত’ গ্রন্থের জাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রবন্ধে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখান :

দেশীয় বুদ্ধিজীবী একটি সংস্কৃতিকে গড়ে তোলার কাজে গভীরভাবে নিয়োজিত; কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না, যে ভাষা, যে কৌশলকে (টেকনিক) তিনি কাজে লাগাচ্ছেন—তা আগন্তুকদের কাছ থেকে ধার করা। এসব কৌশল ও ভাষার ওপর স্বদেশী ছাপ মেরেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে চান; হাস্যকর প্রচেষ্টা—এটা পরগাছাবৃত্তিরই নামান্তর।

৫.

আমি তো মনে করি, মুস্তাফিজের এই ইংরেজি না বলতে পারাটা সেই পরগাছাবৃত্তিকেই বিনির্মাণ করা। এটা একটা শুভ সংবাদ। এটা অক্ষমতা নয়। এই যে তিনি সর্বত্র এখন বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন, এটা আমাদের জন্য অহংকারের ব্যাপার। মুস্তাফিজ নানাভাবে এই একাডেমিক পরিসরকে, জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের সুবিধাজনক পরিসরে (কমফোর্ট জোন) অন্যদের আসতে বাধ্য করেছেন। মুডি, লক্ষ্মণ, ওয়ার্নার, রমিজ সে কারণেই এসেছেন।

এসব ঘটনা অবশ্য এত সহজে একই প্রক্রিয়ায় ঘটতে থাকবে, এমন চিন্তা করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব ঘটাতে বরং বাধ্য করতে হবে। আর এ জন্য আপনাকে হতে হবে নায়কোচিত বৈশিষ্ট্য। ঠিক মুস্তাফিজের মতো বিশ্বমানের। যাঁর কর্মকে কুর্নিশ করবে স্বয়ং চরম প্রতিপক্ষও। আলোচনায় মাতোয়ারা হবে সমগ্র বিশ্ব।

শুধু ক্রিকেটই নয়, জীবনের সর্বত্র-সর্বক্ষেত্রেই আমাদের সেই অর্জনের পিছু নিতে হবে। এ রকম অসংখ্য নায়ক আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। যাঁরা বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের দূত হবেন। বিশ্ব তখন আমাদের পথেই নিজের প্রয়োজনে শিখে নেবে সবকিছু। আপাতত মুস্তাফিজকে এর বড় উদাহরণ বলতে হবে।

ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সেই উদাহরণ বহু যুগ ধরেই হয়ে আছেন। আমাদের অসংখ্য মাস্টারপিস সাহিত্য দরকার, সাহিত্যিক দরকার—পুরো বিশ্বের কাছে সমাদৃত হওয়ার মতো সাহিত্য-সাহিত্যিক। এই ভাষা আপনাআপনিই বিশ্ব দরবারে দাঁড়িয়ে যাবে। ১৯৫২-এর রাজনৈতিক ইতিহাস, ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ইতিহাস তো বিশ্বে আমাদের ভাষাকে বরেণ্য করেছেই; কিন্তু সেই ইতিহাসে আটকে থাকলে তো হবে না। আমাদের এগোতে হবে।

মুস্তাফিজ কিন্তু মুখে কিছু না বলেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। হয়তো না বুঝেও বুঝিয়ে দিয়েছেন। ঘটনা কাকতালীয়ই বটে! তোমার আমাকে দরকার তো? তাহলে তুমি আমার ভাষা রপ্ত করো! রোম্যাঁ রোল্যাঁ শিল্প-সাহিত্য জগতের পীঠস্থান ফ্রান্সে জন্মেও তাই বাংলা শিখেছিলেন। কাকে বুঝতে? বুঝতে হবে, যাঁকে বুঝতে শিখেছিলেন, সেই কীর্তিমান মহীরুহর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

আমাদের অসংখ্য কীর্তিমান মহীরুহ দরকার। দুনিয়া তখন আমাদের দিকে নিশ্চিত ঝুঁকবে।

যতই বলি, হয়তো প্রয়োজনেই মুস্তাফিজকে ইংরেজি শিখতে হবে, এটা নিশ্চিত। তবে জানার পরেও, পারার পরেও, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাতৃভাষায় কথা বলা একটা আর্ট। স্বাধীনতার পরে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তো বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি ইংরেজিও দারুণ বলতে পারতেন। কিন্তু ওই যে, পারার পরেও, মাতৃভাষায় বলাটা একটা আর্টের মতো। ইংরেজি শেখার আগেই, মুস্তাফিজ তাঁর দুর্বোধ্য বোলিংয়ের মতোই, কথাতেও সেই আর্ট দেখিয়ে দিয়ে আমাদের গর্বিত করেছেন।

মুস্তাফিজ, আপনি বাংলাই বলুন পুরো ক্যারিয়ারে। ওরাই বরং আপনাকে বুঝতে বাংলা শিখুক!

৬.

শেষ করি এই বলে যে, আমি মোটেও অন্ধ জাতীয়তাবাদের ফিরিস্তি গাইতে এই লেখার পরিকল্পনার করিনি, সাফাই সাক্ষীও দিতে বসিনি। আমি তো চাই, মাতৃভাষার পাশাপাশি আমরা আরো আরো ভাষায় পারদর্শী হই। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বহুভাষাবিদ হই আমরা। কোনো নির্দিষ্ট ভাষার (ইংরেজি কিংবা উর্দু কিংবা হিন্দি কিংবা আরবি কিংবা ফারসি কিংবা অন্য ভাষা) বিরুদ্ধেই আমার অভিযোগ নেই। কোনো ভাষাকে বড় কিংবা ছোট করতেও আমি বসিনি। ভাষারও একটা রাজনীতি আছে। আধিপত্যের প্রশ্নে সেই ভাষাও আধিপত্যবাদী রাজনীতির কলকাঠি হয়ে ওঠে। আমার বসবার অবস্থানটা ঠিক এর বিরুদ্ধেই; কারো ওপর ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। আমি আসলে কী জন্য বসেছি, সেটা ফানোঁর কাছে ধার করে নিয়েই আবারও বলতে চাই। ফানোঁ তাঁর ওই গ্রন্থের জাতীয় সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পারস্পরিক ভিত্তি নামক আরেকটি প্রবন্ধে বলছেন :

“জাতীয় চেতনা জাতীয়তাবাদ নয়; জাতীয় চেতনাই একমাত্র জিনিস, যা আমাদেরকে আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি প্রদান করবে।... জাতীয় চেতনার অন্তরের অন্তস্তলেই আন্তর্জাতিক চেতনা বেঁচে থাকে এবং বেড়ে ওঠে। এই তরফা অগ্রগতিই পরিশেষে সমস্ত সংস্কৃতির উৎস।”

বাংলা ভাষা সাংস্কৃতিকভাবে আমার মধ্যে একটা জাতীয় চেতনা জাগায়। সে জন্যই বিশ্বমঞ্চের কোথাও বাংলা উচ্চারিত হলেই আমার তৎক্ষণাৎ মনে হয়, আমরা অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনার জবাব এই ভাষাতেই দিয়ে দিতে পারি। সে জন্যই আমার সোনার বাংলা মধুর কথাগুলো আমি মনেপ্রাণে ধারণ করি। কোথাও বাজলে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি। আবেগাক্রান্ত হই, পুলকিত হই। আহা, কী রোমাঞ্চ! কী রোমাঞ্চকর এই মাতৃভাষা!

লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী