মহারাষ্ট্রের খরা

আইপিএলে ঢালা হচ্ছে ৬০ লাখ লিটার পানি!

Looks like you've blocked notifications!

ভারতবর্ষে খরায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এমন রাজ্যগুলোর মধ্যে শীর্ষে মহারাষ্ট্র। যেখানে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক বালতি পানির খোঁজে গনগনে রৌদ্দুর মাথায় নিয়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ। খাবার পানির জন্য ছুটছে তিন-চার মাইল। পুরো রাজ্যে হাহাকার। বৃষ্টি নেই, সহসা হবে এমন পূর্বাভাসও নেই। খাবার পানি নেই, নেই স্নান ও শৌচকার্যের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পানি। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রের লাতুর, বিদ, বিদর্ভসহ বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের জলাশয় শুকিয়ে কাঠ, খাবার পানির মারাত্নক সংকটে সেখানকার লাখো বাসিন্দা। লাতুরে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে পানির অভাবে।

এই পরিস্থিতেই মহারাষ্ট্রসহ ভারতে মহাসমারোহে চলছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল)। রুপালি পর্দায় আইপিএল ক্রিকেট মাতম দেখে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই এ রাজ্যের পানি সংকট কতটা ভয়াবহ-কতটা দূর্বিষহ। এক ফোঁটা পানির জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে সেখানকার প্রতিটি জীবন।  আর সেই রাজ্যে ক্রিকেটের এক ম্যাচ আয়োজনে পিচসহ মাঠ ভেজাতে দেওয়া হচ্ছে তিন লাখ লিটার পানি! ২০টি ম্যাচে লাগবে ৬০ লাখ লিটার পানি! প্রচণ্ড খরাপীড়িত মানুষ যখন এক গ্লাস পানির জন্য ছোটাছুটি করছে, তখন ৬০ লাখ লিটার পানির এই অপচয় কতটা যৌক্তিক? এ কোন বিলাসিতা? মানুষের জন্য পানি নেই, কিন্তু মাঠের ঘাস ঠিক রাখতে পানির অভাব নেই ভারতে। হাজারো প্রাণের চেয়ে ক্রিকেট ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা মুনাফা বেশ লোভনীয়! তাই তো নগদ লক্ষীর আশায় আইপিএল নামের মহামূল্যবান ব্যবসায় লগ্নী করতে ভুল করেনি মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিশেয়ন।

স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহে পুড়ছে ভারতের ১০টি রাজ্য। ভয়াবহ খরার কবলে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, হরিয়ানা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক ও ওড়িশার প্রায় তেত্রিশ কোটি মানুষ। যা ভারতের মোট জনসংখ্যার চারভাগের প্রায় একভাগ। একদিকে তীব্র তাপদাহ অন্যদিকে খাবার পানি না পাওয়ায় এসব রাজ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে সারা ভারতে ২০১৫ সালে মারা গেছে দুই হাজার ১৩৫ জন। খরায় আক্রান্ত ২৫৪ জেলার আড়াই লাখের বেশি গ্রাম। যেখানে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির, গবাদি পশু মরে যাচ্ছে, নাকাল লাখ লাখ চাষি ও কৃষক। অভাব অনটন ও ঋণে জর্জরিত দিশেহারা কৃষকরা আত্মহত্যা করে মুক্তি পথ বেছে নিচ্ছে। বেঁচে থাকতে পানি নেই, মরার আগেও মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারছে না স্বজনরা। অথচ এ রাজ্যে কত উৎসাহ-উদ্দীপনা আর নেচে-গেয়ে চলছে ক্রিকেট খেলা।

ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত রূপ টি-টোয়েন্টির নামে চলছে শত শত কোটি টাকার খেলা। যেখানে কোনো ছোঁয়া লাগেনি পানি কষ্টে মানবেতর জীবনযাপনকারী মানুষগুলোর কষ্ট-বেদনা। ক্রিকেটের গর্ব কী এতই নিষ্ঠুর-নির্মম-অবিবেচক! ক্রিকেটাররা কী ভিন্ন জগতের বাসিন্দা, যাদেরকে রাজ্যের-দেশের এত বড় সংকটও স্পর্শ করে না?

আইপিএলের আয়োজন ভীষণ লাভজনক ব্যবসা, তাইতো ভারতীয় ক্রিকেট লীগ-আইপিএলের এবারের আসরের উদ্বোধন হয়েছে এই ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষের রাজ্য মহারাষ্ট্রে। গত ৯ এপ্রিল উদ্বোধনী ম্যাচসহ এ রাজ্যে হবে  ২০ ক্রিকেট ম্যাচ। এরমধ্যে মুম্বাই আটটি, নাগপুর তিন এবং বাকি নয়টির আয়োজক পুনে। আইপিএলের মাতম থামবে ২৯ মে, ফাইনালসহ মোট ম্যাচের সংখ্যা ৬০টি। ম্যাচ প্রতি তিন লাখ লিটার হিসেবে এবারের ক্রিকেটের ‘শর্টটার্ম বাণিজ্য প্রতিযোগিতায়’ লাগবে এক কোটি ৮০ লাখ লিটার পানি! এ তো শুধু পিচ ও মাঠ ভেজানোর গড়পরতা হিসাব। আবহাওয়া শুষ্ক হলে পানির চাহিদা বাড়বে, যেমন বাড়ে মানুষসহ সব প্রাণীর। খেলার আয়োজন নির্বিঘ্ন করতে গিয়ে আইপিএলে পানি লাগবে দুই কোটি লিটারের বেশি- তা আন্দাজ করা যায়।  

ভারতীয় সংবাদপত্র গণদাবি লিখেছে, “মহারাষ্ট্রে পানি সংকট মোকাবিলায় সাময়িক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে উচ্চ আদালতের ভর্ৎসনার পর। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। মুম্বাই এর থানে ও নাভি এলাকায় সপ্তাহে তিনদিন পানি মিলছে। আর লাতুর এলাকায় ২০ দিনে একবার পানি দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০ থেকে ৫৩ ভাগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে পানির সরবরাহ। ফলে পানির প্রতিটি ফোটা কতটা মূল্যবান তা উপলব্ধির জন্য এ তথ্যই যথেষ্ট।” বৃষ্টি না হওয়ায় ক্ষেতের ফসল পুড়ে খাক। পানির অভাবে নতুন ফসলের আবাদ হচ্ছে না। মহারাষ্ট্রে একবছরে ঋণে জর্জরিত প্রায় দুই হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছে। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে আত্নহত্যার তালিকায় যোগ হয়েছে আরো ৫৭ কৃষক-চাষি। ক্ষেতের ফসল রক্ষায় কেনা কীটনাশক পোকমাকড় ধংসের বদলে নিজের মুখে ঢেলে মুখরক্ষা(!) করছে। অন্যদিকে জমে উঠেছে পানি বিক্রির ব্যবসা। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পানি। পানির মতো সস্তার উদাহরণটি এখন উল্টো বলতে হবে, পানির চেয়ে জীবন অনেক সস্তা এখানে। যাদের পয়সা দিয়ে পানি কেনার উপায় নেই সে পরিবারের নারী-পুরুষরা মধ্যরাতে উঠে ছুটছেন পানির খোঁজে তিন-চার মাইল দূরে। সামান্য যা জুটছে তাই নিয়েই ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে।   

জনস্বার্থে অন্তত মহারাষ্ট্র থেকে আইপিএলের ম্যাচগুলো সরিয়ে নিতে আদালতে দারস্ত হয়েছেন ভারতীয় আইনজীবী অঙ্কিত ভার্মা। ধান-গম-ভুট্টাসহ ফসল ঘরে তুলতে লাগে ন্যূনতম তিন-চার মাস। সেখানে দুই মাসের কম সময়ের আইপিএল ব্যবসায় মিলবে নগদে হাজার হাজার কোটি টাকা। পুঁজির ধর্মই মুনাফা, আরো লাভ আরো মুনাফা। সুতারং যেখানে মুনাফা সেখানেই ছুটবে পুঁজি। তাতে দুই চার হাজার মানুষের খাবার পানি না পেয়ে মারা গেলেও কিছু যায় আসে না, নগদ নারায়ণ এলেই চলবে। ফলে আইপিএলের ম্যাচগুলো সরিয়ে নেওয়ার আবেদন কতটা গ্রাহ্য হবে তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। “আইপিএল মহারাষ্ট্রে না হলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। শুধু আর্থিক দিক দিয়েই নয়, সব দিক থেকেই ক্ষতি হয়ে যাবে।” ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক বোর্ড বিসিসিআইয়ের সচিব ও শাসক বিজেপির সংসদ সদস্য অনুরাগ ঠাকুরের এই মন্তব্যের পর সামন্য আশাটুকু উবে গেছে। সত্যিই খেটে খাওয়া মানুষ, চাষা-ভূষারা মরলে তো দেশের ইজ্জত যায় না, যাওয়ার কথাও না। পানীয় জলের অধিকার দিতে না পারলেও আত্মহত্যার অধিকার তো দিয়েছে শাসক দল- এই কী কম পাওয়া?

অর্থনৈতিক শক্তির বিচারে ভারত এখন মহাশক্তির দেশ। দেশটির রির্জাভ তরতর করে বাড়ছে, স্বর্ণের মজুদ ছাড়িয়েছে ৩০০ মণ। বিশ্বব্যাংক বলছে, দুই কোটির বেশি জনসংখ্যা এমন ১১৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ গেল বছরে ৬ ভাগের বেশি জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। যে তালিকায় ৭ দশমিক ৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভারতের অবস্থান ৫ম। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, বিশ্বব্যাংকের প্রবৃদ্ধি অর্জনে সফল ১২ দেশের ওই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ নম্বরে। কিন্তু ভারতের এই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে কে? দেশ যদি এত ভালো করছে তাহলে মহারাষ্ট্রসহ খরায় জর্জরিত ১০ রাজ্যের প্রায় তেত্রিশ কোটি মানুষের জীবনে কেন এ দুর্দশা? কেন সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ ও অপুষ্টির শিকার শিশুর বসবাস এই ভারতে? এ প্রশ্নের উত্তর কোথায়? সরকার কী আইপিএলের মতো কতিপয় মুনাফালোভী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সেবা দিতে ব্যস্ত? রাষ্ট্র তো সবার, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদার ভারতের এ কোন চেহারা? এ বছর ক্রিকেট নামে ‘বৈধভাবে জুয়ার আড্ডার’ আয়োজন না করলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? খেলার মাঠের পানি দিয়ে অন্তত কয়েক লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা তো বাঁচানো যেত। দেশের পাহাড়সম রির্জাভের মতো বিসিসিআইয়ের টাকার মজুদও বাড়ছে। সম্পদশালীদের মতো ধনী খেলোয়াড়দের বিশ্ব তালিকায় ভারতীয় খেলোয়াড়রা জায়গা করে নিচ্ছে। অথচ সেই ভারতে পানির কষ্টে-খাবারের অভাবে প্রতিদিনই মানুষ মরছে দলে দলে। 

আইপিএলে ক্রিকেটারদের জুয়ার আসরের মতো করে কেনা হয় দলে।। আয়োজনে বাড়তি রং দিতে বাইরের দেশের ক্রিকেটারদের কিনছে একদল পয়সাওয়ালা। যাদের সঙ্গে ক্রিকেটের নেই সম্পর্ক। লোভনীয় সেই হাতছানিতে ছেলে বুড়ো সব ক্রিকেটাররা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মুস্তাফিজের জন্য বাংলাদেশি দর্শকরাও টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখছে। ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ নষ্ট করছে ক্রিকেটের সৌন্দর্য, বাড়ছে বিজ্ঞাপন দাতাসহ পুঁজিপতিদের আধিপত্য। তাই ক্রিকেটার ও আয়োজকদের আয় ও পারিশ্রমিকের সঙ্গে মিশে থাকবে দু-একটি নয়, শত নয়, লাখ নয়, কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস! মানুষকে তৃষ্ণার্ত রেখে খেলার পেছনে খরচ করাটা পানির ব্যবহার না অপব্যবহার তা বিচারের ভার সে দেশের জনগণেরই।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন।