বিশ্ব মা দিবস

আমার ‘মা’ আমার ভালোবাসা

Looks like you've blocked notifications!

“মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই, 

ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।
সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক মাথার’ পরে আজি
অন্তরে মা থাকুক মম ঝরুক স্নেহরাজি।”
 
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ কী অসাধারণ লিখেছিলেন! এত অসাধারণ অভিব্যক্তিতে মায়ের বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে এসেছে কি না, সেটা আপেক্ষিক। পৃথিবীতে অনবদ্য, অনন্য আর অসাধারণ যে বিশেষণই দেন না কেন, একমাত্র মায়ের জন্য সেটা মানানসই। কোনো ক্রমেই মায়ের সঙ্গে তুলনা করা চলেই না। ক্রমবর্ধমান এ ধরা আজ, কাল, পরশু করে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। দিনবদলের এ পালে, হালের আরো বেশ কিছু অনুষঙ্গের সঙ্গে মা দিবস নামে এক অনুষঙ্গ যোগ হওয়ার পর; বিশেষ এ দিনটি নিয়ে আমাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এ যেন ভালোবাসার মাঝে বেঁচে থাকার নির্মল আকুতি। এক টুকরো কমতি নেই মায়ের ভালোবাসায়।

যান্ত্রিক এ সময়ে মায়ের জন্য ভালোবাসার ঘটতি পড়াতে এ আয়োজন? না, অতিরিক্ত ভালোবাসা বিনিময়ের জন্য বিশেষ কিছুর প্রয়োজনীয়তা বোধে এটা এসেছে? সেটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে এটা সর্বজন গ্রহণযোগ্য যে, মায়ের প্রতি ভালোবাসা একদিনের জন্য হতে পারে না। যেটা অনন্তকালের, সেটা শেষ হওয়ার নয় আর ওটাই হলো মায়ের প্রতি ভালোবাসা! এ জন্যই তো একমাত্র মা-ই হারিয়ে গিয়েও বেঁচে থাকে বহুদিন। যে আবেদন স্বয়ং বাবাও ধরে রাখতে পারে না, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের জন্য হয়ে থাকে। মা ও বাবা দুজনেরই সমান অবদানের কথা বলা হলেও বাবা খানিকটা আড়ালেই থাকেন মায়ের অপরিসীম আর অনবদ্য ভূমিকার কারণে। মা হলো একাধারে অভিভাবক, বন্ধু বা কাছের একজন, যাঁর সঙ্গে অভিমান কার যায়, আবার নিজের ভেতরের সবকিছু উগড়ে দেওয়া যায়।

পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্ট হবে যে মাকে ভালোবাসে না। ব্যতিক্রমের বিষয়টা বাদ দিয়ে এটাই আমাদের সাধারণ জীবনের অসাধারণ এক সমীকরণ। যে বৃত্তে বন্দি প্রায় প্রতিটি প্রাণী; শুধু মানুষ বললেই ভুল হবে, প্রায় প্রতিটি জীবই মাতৃত্বের এই আলোকসামান্য গোলকধাঁধার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, মাতৃত্বের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যদি ব্যাহত হতো। তাহলে অবস্থাটা কী হতো? আর যাই হোক, যে এক জীবনে মাকে পেল, সে মাকে হারাতে চাইবে না কোনো দিন। মা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন। এই পৃথিবীতে মা ছাড়া কেউ তাঁর সন্তানকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসে না। মায়ের ভালোবাসার মধ্যে আছে প্রকৃত সুখ। দূর গাঁয়ে ফেলে আসা মায়ের মুখ, মায়ের স্নেহ ছায়ায় বেড়ে ওঠা, মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার বেদনা কিংবা সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দূর অজানায় পাড়ি জমানোর পর মায়ের স্মৃতি। এসবই আমাদের প্রতিনিয়ত পোড়ায়। হু-হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা। আর যখনই মায়ের কথা মনে পড়ে, মনের অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। ইচ্ছা করে ছুটে যাই মায়ের কাছে। একচিলতে আদর আর শাড়ির আঁচলে মুখটা বেঁধে ডুব দিই ভালোবাসার সাগরে। জন্মের সূচনাপর্ব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মায়ের অবদান অতুলনীয়। কিন্তু প্রতিটি সন্তান যেমন তার মাকে সব সময় যথেষ্ট সম্মান দিত না, ঠিক তেমনি মাও তাঁর মাতৃত্বের অকৃত্রিম ভালোবাসা ভুলে নিজের মতো করে অবিবেচনাপ্রসূত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। 

সম্প্রতি মা কর্তৃক শিশু হত্যা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঠিক এখনি মুদ্রার উল্টো পিঠটা না দেখিয়েই বলতে চাই, মাকে যে তার সন্তান কোনো কষ্ট দিচ্ছে না, এমনটাও নয়। যে মা আমাকে ১০ মাস ১০ দিন পেটে রেখে এই ধরার আলোতে নিয়ে এলেন পরম মততায়, সেই মাকে আমি কিংবা আপনি শেষ যাত্রার প্রক্কালে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে মানবিক মূল্যবোধবিবর্জিত কাজ করে চলেছি। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ওই মানুষটার কান্না যদি একবার দেখা যেত, তাহলে অনুমান করা যেত কী কষ্ট নিয়ে ওখানে দিন কাটে তাঁর। আর এদিকে প্রেয়সীর সঙ্গে আপনার-আমার সংসার চলে রাজার হালে। ঠুনকো বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করছি যখন তখন। কোনো কারণ ছাড়াই মাকে কষ্ট দেওয়া আর মানসিক চাপে রাখা আধুনিক সমাজের একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। মাকে চাপে রাখতে পারলেই সে মুক্তবিহঙ্গে ডানা মেলে উড়তে পারে, এ ধারণা মায়ের প্রতি সাধারণ কর্তব্য পালনে বাধা দেয়। আবদার না মিটতে পারলে মায়ের ওপর চাড়াও হওয়াটা আমাদের স্বভাবের সঙ্গে মিশে গেছে। 

আর ঐশীর মতো সন্তানরা মা-বাবাকে গলা কেটে হত্যা করতেও একটু বিচলিত হয় না! সভ্যতার উৎকর্ষ তাই মাঝেমধ্যে অসভ্যতার উৎকর্ষকে উসকে দিচ্ছে কি না, সেটা ভাবার প্রয়োজন আছে। এসব একেকটি উদাহরণ আপনাকে আমাকে ভাবাবে, যেখানে সবারই দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। এই মায়ের জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভরা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এ সমাজে এখনো অনেকেই আছেন, যাঁরা বিয়ে করে সংসার করেননি মাত্র মাকে সেবা করার জন্য। পাগলামি মনে হলেও মায়ের সেবা করার আনন্দ যে অন্য রকম, তা কেবল যার মা আছে, সে-ই বুঝবে। মা, যাঁরা আমাদের জীবনের অনন্য এক আশ্রয়স্থল। যদি পৃথিবীর প্রতিটি মা আরো সহিষ্ণু, আরো মমতাময়ী ও কল্যাণকামী না হতেন, তবে মানবসভ্যতার চাকা শ্লথ হয়ে যেত।

মায়ের ভালোবাসা নিয়ে আজ নানা অনুষঙ্গেও একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন; মায়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দকৃত একটি দিন, মা দিবস। বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস শতবর্ষের পুরোনো। যুক্তরাষ্ট্রে আনা জারভিস নামের এক নারী মায়েদের অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসচেতন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে আনা জারভিস মারা গেলে তাঁর মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সচেষ্ট হন। ওই বছর তিনি তাঁর সানডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃদিবস হিসেবে পালন করেন।

১৯০৭ সালের এক রোববার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায় মা দিবস আজ বিশ্বব্যাপী এক ধারণা। 

প্রতিটি সন্তান তার মায়ের কাছে কারণে-অকারণে অনেক কিছুই চেয়ে থাকে? আপনি আপনার মাকে কোনো দিন প্রশ্ন করেছেন—মা, তোমার কী চাই? না, সেটা বোধ হয় হয়ে ওঠেনি! তাহলে মায়ের কাজ কি শুধু নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যাওয়া? সন্তানের কাছে তাঁর কোনো চাওয়া থাকতে নেই! 

প্রতিটি মায়েরই কিছু চাওয়া থাকে তাঁর সন্তানের কাছে। অন্য আর সব ব্যতিক্রমের সঙ্গে সন্তানের কাছে মায়ের চাওয়ার ধরনটাও একটু আলাদা! মা চান, তাঁর ছেলের জন্য যোগ্য একটা বউ আর মেয়ের জন্য সুপাত্র! কী রোমান্টিক, তাই না? এমনটা সব মায়েরই চাওয়া। একজন মা প্রকৃতপক্ষে তাঁর সন্তানের জন্য যা চান, তা আরো সত্য, আরো হৃদয়ছোঁয়া। মা চান, তাঁর সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক। সন্তানটা তাঁর সঙ্গে আজীবন মিলেমিশে থাক। খারাপটা বর্জন করুক আর ভালো কিছু শিখুক। মা চান, সন্তানের সুন্দর একটা জীবন। প্রয়োজনে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে হলেও তাঁর সন্তানের জীবন সুখী করার প্রয়াস মাত্র মায়েরই মানায়। মায়ের এসব চাওয়ার ধরন তাঁর সন্তানকে ঘিরে। মা কি আসলে তাঁর নিজের জন্য কিছু চান? হ্যাঁ, চান। প্রত্যেক মা-ই তাঁর নিজের অজান্তেই চান, তিনি যেমন তাঁর সন্তানকে অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে বেঁধে রাখেন, তাঁর সন্তানও তেমনি তাঁর প্রতি ভালোবাসার ডানা প্রসারিত করুক। মুখের নয়, প্রত্যেক মায়ের মনের এই আশা পূরণের জন্য আমরা সকলেই সচেষ্ট হই। মা দিবসে প্রতিটি মায়ের প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা ও নিরন্তর ভালোবাসা। 

লেখক : ‘দ্য ডেইলি সান’ পত্রিকার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।