ইলুভেইটির কনসার্ট স্থগিত

গানওয়ালাদের সঙ্গে যেভাবে আমরা এ দেশকে অপমান করলাম

Looks like you've blocked notifications!

‘বাবা বলে গেল, আর কোনো দিন গান কোরো না

কেন বলে গেল, সেই কথাটি বলে গেল না!’

বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড সুইডিশ ফোক মেটাল ব্যান্ড ইলুভেইটির কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল গতকাল। যাঁরা তাদের গান সম্বন্ধে সামান্যতমও জানেন, তাদের জন্য যে এই বিষয়টা কতটা দারুণ আর স্বপ্নে মতো ছিল, তা বলা বাহুল্য। তবে আমাদের বাংলাদেশে স্বপ্ন এবং বাস্তবতার ফারাক এতটাই যে, স্বপ্ন মাঝেমধ্যে বাস্তব হয়ে গিয়েও দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে যখন-তখন। এ বিষয়টিও তেমনই হয়েছে, কনসার্টটি আর শেষপর্যন্ত হয়নি, বাংলাদেশে এসেও গান করতে পারেনি ভিনদেশি এই গানওয়ালারা।

ভেন্যু থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে গুলশান ২-এর একটি হোটেলে বসে তারা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল মঞ্চ কাঁপানোর, তখন বসুন্ধরা কনভেনশন সিটির সামনে বৃষ্টিতে ভিজছিলো শত শত মেটাল সংগীতের ভক্ত-প্রেমী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী। তাদের ভেন্যুতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। কারণ, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ার কারণে শো ক্যানসেল!

আয়োজকদের ভুল, তাঁরা এই অনুষ্ঠানের জন্য পুলিশের (বিশেষ শাখা) এসবির ক্লিয়ারেন্সের কাগজটা জোগাড় করেননি। কিন্তু কাল দুপুরে যখন সেটা জানার পর দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো, তখন কেন এসবি থেকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হলো না? এটা তো দেশের সম্মানের বিষয় যে বাংলাদেশে এই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের, এতটা বিখ্যাত কোনো একটা মেটাল ব্যান্ড এলো! তড়িঘড়ি করে কি বিশেষ ব্যবস্থায় কাল এই অনুমতিটা দেওয়া যেত না? এত বড় একটা সাংস্কৃতিক সংযোগের সুযোগ আমরা কেন হাতছাড়া করলাম? এই দলটিকে পুরো দুনিয়ার মানুষ চেনে। তারা যেই দেশে গিয়ে ‘নিরাপত্তার অভাব’-এ অনুষ্ঠান করতে পারে না, সেই দেশের ভাবমূর্তিটা দুনিয়ার কাছে কেমন হবে, তা কি কারোই মাথায় এলো না?

মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, যে দেশে নয়দিনে ৪১ খুন হয়, যে দেশের জনপ্রতিনিধিরা একই ঘরানার খুনগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে নিশ্চিন্তে ঘোষণা করে যান, যেখানে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বিষয়টাকেই আলাদা একটা ‘ঘরানা’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়, সেখানে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের ছুঁতোয় একটা ইন্টারন্যাশনাল ব্যান্ডকে গান না গেয়ে ফিরে যেতে হলো। এটাও হয়তো একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তাই না! ইলুভেইটির যত গাইয়ে ছিলেন, হয়তো তাঁরা সারা দুনিয়া ঘোরার সময় বলতে পারতেন যে বাংলাদেশের দর্শক কত দারুণ, কিন্তু এখন হয়তো তাঁরা এমনটাই বলবেন সখেদে— ‘এই বছর ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হয়ে নানা দেশে এখন পর্যন্ত ২৯টা কনসার্ট করে ফেললাম, কেবল বাংলাদেশই এমন একটা দেশ যেখানে গিয়েও গাইতে পারিনি।’ এর কারণ অবশ্য ওনারা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, বুঝতে পারছি না। ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ জেনারটির বাংলাদেশীয় সংজ্ঞা তাঁদের অন্তত শিখিয়ে দেওয়া তো দরকার ছিল!!

আয়োজকপক্ষ ‘গ্রিন’ ইভেন্টকে নিয়ে কিছুই বলার নেই। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিশ্চয়ই কোনো শখের কাজ না, যেখানে কল্পনার সঙ্গে দুই গজ হাঁটলেই পুরো মাঠ পার হয়ে যাওয়া যায়! কোনো একটা কিছু না জেনে আর সেখানকার পরিস্থিতি না বুঝে সেদিকে এগোনোটাও নেহাত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়। এই অজস্র শ্রোতা আর ভক্তরা যারা এত টাকা দিয়ে টিকেট কিনে এত আশা নিয়ে এসেছিল, ‘গ্রিন’ তাদের কী বোঝাবে বা এর জন্য কী ব্যবস্থা নেবে, তারাই জানে। পুরো বিষয়টাই প্রচণ্ড রকম অপেশাদারিত্বের চূড়ান্ত নমুনা।

আমরা উদাহরণ দিতে গিয়ে বলি ভবিষ্যতের গুগল, ভবিষ্যতের ফেসবুক বাংলাদেশ থেকে হবে। উদাহরণ দিতে গিয়ে আমরা কখনো বলি না ভবিষ্যৎ মেটালিকা, আয়রন মেইডেন বা নির্ভানা আমাদের দেশ থেকে আসবে! কারণ আমরা ব্যবসা বুঝি, টাকা-পয়সা বুঝি, গোল্ডেন জিপিএ ৫ বুঝি, বোমা বুঝি, রাজনীতি বুঝি! সংগীত ‍বুঝি না, মনও বুঝি না, বোঝার দরকারও মনে করি না। এমন চলতে চলতে একসময় হয়তো আমাদের নিজেদেরই আর চিনতে পারব না, বুঝতেও পারব না।