অভিমত

থানচিতে খাদ্য সংকট প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা

Looks like you've blocked notifications!

একটা গল্প বলি। অনেকদিন আগের কথা। শ্রাবণ মাস। জুমিয়াদের খাদ্য সংকটের মাস। এক জুম চাষি খাদ্যাভাবে তাঁর আট-দশ বয়সী একটি ছেলেকে বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে কাল্লোংয়ে (পিঠে চড়ানো ঝুড়ি) বসিয়ে জুম থেকে নিয়ে যাচ্ছে। জুম পথ। কাল্লোংয়ের ডানে-বামে ধানের শীষের স্পর্শের শব্দ শুনতে পেয়ে ছেলেটি তাঁর বাবাকে জিজ্ঞেস করে, 'বাবা, এটা কিসের শব্দ?' বাবা উত্তরে বললেন, 'কাল্লোংয়ে ধানের শীষ লেগে শব্দ করছে'। তখন ছেলেটি তাঁকে কাল্লোং থেকে নামাতে বললে তাঁর বাবা নামালেন। ছেলেটি দেখল, ধানের শীষ না পাকলেও পরিপক্ব হয়েছে। তখন ছেলেটি বাবাকে বলল, আমাকে বিক্রি না করে এ আধপাকা ধান কেটে তা সিদ্ধ করে রোদে শুকালেও তো আমরা খেতে পারি। ছেলের কথায় বাবা ধান কেটে তা সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে ভেনে খোরাক জোগাড় করলেন। এভাবে ধান না পাকা পর্যন্ত এডাপটেশন(অভিযোজন) করলেন তাঁরা। ছেলেটিকে আর বিক্রি করতে হলো না। 


নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশের একটি অঞ্চল বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলা। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, সেখানে এখন চরম খাদ্য সংকট চলছে। কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমে থানচির ভৌগোলিক অবস্থান জানা দরকার। থানচি একটা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। যেখানে সমতল ধান্যজমি নাই বললেই চলে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যেখানে বসবাস করে সেখানে। তাঁদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম একমাত্র জুম চাষ। ঢালু পাহাড়ের গভীর জঙ্গল কেটে তা সাফ করে তাতে ধানসহ হরেকরকম শাক-সবজি ফলিয়ে তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে স্থানীয়রা। খবরের বিবরণমতে, গত বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে জুমচাষে ফসল বিপর্যয় হয়েছিল। এ কারণে সংকটে তারা। বৈরী আবহাওয়াতো বটেই। কিন্তু আসল রহস্য খুঁজলে দেখবেন, তাদের চাষকৃত জুমের পরিত্যক্তকাল এক থেকে দুই বছর হবে মাত্র। যেখানে জুম চাষের প্রকৃত নিয়ম জুমচাষ পাহাড়কে পরবর্তী চাষের জন্য পাঁচ-ছয় বছর পরিত্যক্ত রাখতে হয়। কিন্তু এখন জমি এতই অপ্রতুল যে, এ নিয়ম ধরে রাখা খুবই কষ্টকর। 

এ নিয়ম কেবল থানচিতে নয়। সব আদিবাসী জনগোষ্ঠী জীবিকার মাধ্যম হিসেবে জুম চাষই করে থাকত।

বলা হয়ে থাকে, জুম চাষ আদিবাসীদের একটা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন বাজার। যেখানে তারা ধানসহ তিল, তুলা, মসলা, শাক-সবজি প্রায় সবকিছু ফলাত। কথিত আছে, এক সময় আদিবাসীরা কেরোসিন আর লবণ ব্যতীত পুঁজিবাজার থেকে কিছুই কিনত না। তুলা থেকে সূতা, সূতা থেকে কাপড়। তিল থেকে তেল নিজেরাই তৈরি করত। ফলাতো মসলা শাক-সবজি সবকিছু। এমনকি, কেরোসিন তেল (জ্বালানি)ও তেমন একটা কিনত না। গর্জন গাছের নির্যাস দিয়ে আলোর কাজ করে নিত।

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সব সরকারই চেষ্টা করেছিল জুম চাষ বন্ধ করতে। যদিও ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে তা বন্ধ করা হয়নি। এখনো সম্ভব হয়নি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তৎকালীন সরকার জুম চাষ বন্ধ করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তা পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়। সমতল জেলা থেকে পাঁচ লাখ বাঙালি পাহাড়ে এনে বস্তি স্থাপন করে দেওয়া হয়। এটা অবশ্য আগের সরকারেরই দাম্ভিক প্রতিশ্রুতি ছিল। একদিকে, জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করিয়ে আদিবাসীদের জমি দখল করা হলো অন্যদিকে, আদিবাসীদের জুমচাষকৃত পাহাড়গুলোতে রাবারের চাষ শুরু করে দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে, বনবিভাগকে দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে সেগুন বাগানও করতে থাকে জুম চাষকৃত পাহাড়েই।


থানচির মতো দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় খাদ্য সংকটের একটা বিশেষ কারণ সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের অভাব। অথবা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা। পাহাড়ি এলাকায় খাদ্য উৎপাদনের প্রধান মাধ্যম একমাত্র জুম চাষকে নিরুৎসাহিতকরণের মধ্য দিয়ে জুম চাষ একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। ‘জ্বি হুজুর’ মার্কা কিছু গণমাধ্যমকে দিয়ে জুম চাষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার চেষ্টা হচ্ছে বারবার। বিভিন্ন সময়ে থাকা ক্ষমতাসীনরা জুম চাষকে পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হিসেব চিহ্নিত করে বিভিন্ন কৌশলে জুম চাষ বন্ধের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখায় আজ থানচিতে পাহাড়িরা চরম খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। অথচ জুম চাষ মানব জাতির কৃষির সূচনার উদাহরণ। 

জুমে ধান চাষের পরিবর্তে সেখানে প্রাণীর সরাসরি ভোগে অযোগ্য পরিবেশবিরোধী ও জীববৈচিত্র্যবিরোধী মনোকালচার রাবার আর সেগুন চাষ করার মাধ্যমে আদিবাসীদের পুঁজি নিয়ন্ত্রণমুক্ত বাজারকে ডাকাতি করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে পাহাড়ের পশুপাখিও খাদ্য সংকটে পড়েছে বহু বছর আগে থেকে। কারণ, রাবার আর সেগুনের ফল কোনো প্রাণি ভক্ষণ করতে পারে না। এমনকি রাবার-সেগুন বাগানে কোনো পশুপাখির বাসাও দেখা যায় না। অন্যদিকে, সেগুন পানির স্তরও ধরে রাখতে পারে না বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন।

আদিবাসী নেতারা প্রায় সময় অভিযোগ করে থাকেন, জুমচাষ বন্ধ করে তাতে রাবার-সেগুন চাষ করারও একটা গোপন কারণ রয়েছে। কারণ, জুমচাষই আদিবাসীদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ছিল। এ মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে পারলে আদিবাসীরা জিন্দিগিতে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে না অথবা দেশ ত্যাগ করতে হবে।

যুক্তি, একেবারে সোজা- রাবারের নির্যাস বিক্রি করতে হবে। ক্রেতা যে দামে কিনতে চাইবে সেই দামে বিক্রি করতে হবে প্লান্টারদের। সুতরাং অর্থনৈতিক লাগাম ক্রেতার হাতে। সেগুন গাছের কাঠ বিক্রি করতে হলে সরকার বা বনবিভাগের অনুমতি লাগে। নিজের বাগানের সেগুন গাছ যখন তখন বিক্রি করতে পারবে না কেউই। লাগাম সরকারের হাতেই।

লেখার শুরুটা গল্পের মতো, এক সময় জুমের ধান পুরোপুরি পাকার আগেও ধান কেটে তা সিদ্ধ করে শুকিয়ে ভেনে খেতে পেরেছিল জুমচাষিরা। এখন কী খাবে? সেগুনের বিচি না গাছ? নাকি রাবারের বিচি? নাকি রাবারের নির্যাস?

লেখক : সংগঠক