বাংলাদেশের অস্তিত্বের লড়াই
এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশে সেক্যুলার ব্লগাররা অবরুদ্ধ আছেন। সোমবার ধর্মবিষয়ে মুক্তচিন্তার কারণে ওয়াশিকুর রহমান নামের এক তরুণ ব্লগারকে প্রকাশ্যে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকাভিত্তিক ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি অনিমেষ রহমান বলেন, ‘আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমার জীবন প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকিতে আছে। আমার মতো লোকজনের টিকে থেকে লড়াই করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের আত্মাকে জীবিত রাখতে আমরা জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্লগার অভিজিতের মৃত্যুর পাঁচ সপ্তাহ পর ওয়াশিকুরের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাহিত্যের আসর একুশে বইমেলায় গিয়েছিলেন। অনলাইনে তাঁর একটা পরিচিতি ছিল যেটা ইসলামে মৌলবাদ ও চরমপন্থাকে চ্যালেঞ্জ করতেন। এ অবস্থানের কারণেই তিনি মৌলবাদীদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। তাঁকে চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয়েছে।
অন্যতম অনুসারী ওয়াশিকুর অভিজিতের মৃত্যুতে এতটাই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর স্মরণে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেছিলেন। এ পেজটির নাম ছিল ‘আই অ্যাম অভিজিৎ’ (আমিই অভিজিৎ)।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবর অনুযায়ী, ওয়াশিকুর ২০১৩ সালে খুন হওয়া থাবা বাবা হিসেবে পরিচিত ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জন্যও শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর (রাজীব) আদর্শে অবিচল থেকে লড়াইয়েরও অঙ্গীকার করেছিলেন। ইসলামী চরমপন্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদই তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে।
বাংলাদেশে ব্লগাররা কেন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে?
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা একদল ব্লগারের সঙ্গে আমি দেখা করি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে গড়ে ওঠা অনলাইনভিত্তিক শাহবাগ আন্দোলনের (গণজাগরণ মঞ্চ) কয়েক মাস পর আমরা দেখা করি।
ওই আন্দোলনের সময় (গণজাগরণ) জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থীরাও পাল্টা তৎপরতা চালাচ্ছিল। তাঁরা গ্রেপ্তার নেতাদের (যাদের বেশির ভাগই পদস্থ) মুক্তি দাবি করেছে।
সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদীদের মধ্যকার তিক্ত এই আদর্শিক সংঘাতের বলি হয়েছেন শাহবাগপন্থী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
চাপাতি হাতে থাকা তরুণরা রাজীবকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অভিজিৎ রায় ও ওয়াশিকুর রহমানের ক্ষেত্রেও প্রায় একই পন্থা অনুসরণ করা হয়েছে।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে দুই ব্লগার আরিফ জেবতিক ও মারুফ রসুলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ইসলামপন্থীদের হুমকির মুখে দুজনই আত্মগোপনে আছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীরা সক্রিয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় না এমন ব্যক্তিদের লক্ষ্য বানাচ্ছে।
অনিমেষ রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। শাহবাগ আন্দোলনের সময় থেকেই ওয়াশিকুরের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। তিনি যোগ করেন, ‘সেক্যুলারপন্থীদের সঙ্গে ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের লড়াই এখনো চলছে। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছে বটে। কিন্তু চরমপন্থা থেকে মুক্তি পায়নি, যার বীজ বপন করেছিল ইসলামাবাদ।’
অনিমেষ রহমান এখনো প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘পুরো ব্লগার কমিউনিটি আতঙ্কে। আমরা মরে যেতে পারি। কিন্তু লেখালেখি বন্ধ করব না। ইসলামী চরমপন্থা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের চালিত করছে।’ তাঁর ওয়েবসাইট মুক্তচিন্তাব্লগডটকম প্রগতিশীল রাজনীতি ও যুক্তিবাদের ওপর জোর দেয়।
কিছু তরুণ নেতা ইসলামী মৌলবাদকে সহ্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন।
ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য লড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সরকার এখনো মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষকতা করছে।’ তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা সারা দেশে ৫০০ মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। আপনি যদি মৌলবাদীদের সঙ্গে সখ্য গড়েন, তাহলে কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন?’
বাপ্পাদিত্য শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। বিভিন্ন সময় তিনি উগ্রবাদীদের হুমকির শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মৌলবাদী শক্তি হাজারবারের বেশি আমাকে হুমকি দিয়েছে। ডিসেম্বরে তারা আমার বোমা ছুড়ে মারে। কিন্তু আমি সে যাত্রায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যাই। আমি জীবনের তোয়াক্কা করি না। আমরা লড়াকু জাতি। দেশকে উগ্র ইসলামপন্থী শাসনের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।’
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ইসলামপন্থী মৌলবাদী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামকে মদদ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ বাপ্পাদিত্য। শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে জোরালো হওয়া প্রধান গোষ্ঠী ছিল এটি (হেফাজত)। আন্দোলনের সোচ্চার কণ্ঠ আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যায় হেফাজতকে দায়ী করা হয়।
এসব হত্যা বাংলাদেশের সংঘাতময় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। ইসলামাবাদ থেকে স্বাধীন হতে পূর্ব পাকিস্তান যখন যুদ্ধ করছিল, তখন জামায়াতে ইসলামী এর বিরোধিতা করেছিল। তারা বাছাই করে হত্যা করছিল। এই গোষ্ঠীটি হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে (শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও যারা সেক্যুলারপন্থার পক্ষে লড়েছিল) হত্যা করেছিল।
পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের মুসলমানরা নিজেদের সর্বপ্রথম এবং সর্বোপরি বাঙালি মনে করে। ইসলামপন্থী চরমপন্থীরা দেশের মূল চরিত্র বদলে দিতে চায়। অনিমেষ রহমান ও বাপ্পাদিত্য বসুর মতো যুবকরা দেশের প্রাণ ও চেতনাকে টিকিয়ে রাখতে জীবনকে সংকটে রেখেছেন। তারা দেশের সেক্যুলারপন্থার সর্বশেষ রক্ষী।
সঞ্জীব রায় ভারতের টেলিভিশন এএনআইয়ের প্রতিবেদক ও প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি পাঁচ বছর ধরে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সহিংসতার খবর সংগ্রহ করেছেন। ৩ এপ্রিল তাঁর লেখা নিবন্ধটি চলমান ঘটনাবিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আজহারুল ইসলাম।