প্রতিক্রিয়া

গরিব বলে বিচার পান না তনুরা!

Looks like you've blocked notifications!

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু খুনের পর গত হয়েছে তিনটি মাস। এখনো এই মর্মান্তিক খুনের কোনো কূলকিনারা হয়নি। একজন আসামিও ধরা পড়েনি। পরপর দুই বার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলেও এখনো উদঘটিত হয়নি খুনের প্রকৃত কারণ। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে তনু খুনের আগে ধর্ষিত হয়েছিল বলে আলামত পাওয়া গেছে। তনুর লাশ ও গায়ের কাপড়ের ডিএনএ পরীক্ষা করে সেখানে ভিন্ন তিন ব্যক্তির বীর্য পাওয়া গেছে। তবে এ ধর্ষণ কারা করেছে এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তারা এখনো ঘোর অন্ধকারে। আসামি গ্রেপ্তার তো বহুত দূরের কথা!

মেয়েকে হারানোর তিন মাস গত হয়ে গেল অথচ তার হত্যাকারীদের কাউকেই এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করতে পারল না দেখে তনুর মা হা-হুতাশ করে বুক চাপড়ে বলছেন- ‘গরিব বলে কি আমরা বিচার পাব না? আমার মেয়েকে এইভাবে মেরে ফেলবে? কেউ কিছুই করবে না? কোনো অপরাধী ধরা পড়বে না? আমার মেয়ের খুনিরা কেউ শাস্তি পাবে না?’

আপাত দৃষ্টিতে তনুর মায়ের এমন বুক ফাটা আর্তনাদ প্রলাপ মনে হতেই পারে। তবে বিষয়টিকে একটু গভীরভাবে দেখলে কেবলই একজন সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ হিসেবে থাকে না আর। ফুটে উঠে এখানকার চরম বিচারহীনতার সংস্কৃতির অন্ধকার দিকটি। তনুর মা যদি বলে থাকেন, যে তারা কেবল গরিব বলেই বিচার হচ্ছে না, তবে তিনি খুব বেশি ভুল বলেছেন সেটা বলা যাবে না। কারণ, সবলের পক্ষে যে পরিমাণ আইনি তৎপরতা দেখা যায়, দূর্বলের পক্ষে তা প্রায়শই দৃষ্টির আড়ালে। প্রভাব পতিপত্তি অর্থবিত্ত প্রাচুর্য যেন গোপনে নাড়ে এখানে সব কলকাঠি।

শুধু এক তনু হত্যাকান্ড কেন, সারা দেশে এমন অহরহ ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। যার বিচার হচ্ছে না কার্যত একটিরও। উল্টো এসব ঘটনায় ভিকটিম ব্যাক্তি বা পরিবার চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে নিপতিত হচ্ছে হামেশাই। অর্থ বিত্তে শক্তিশালী, বলশালী প্রতিপক্ষের হুমকি ধমক, মারধর, প্রাণ নাশের হুমকি কোন কোন ক্ষেত্রে এলাকা বা দেশ ছাড়া করার হুমকির ঘটনাও নিয়মিতই শোনা যায়। এসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ভিকটিম পরিবার বা ব্যক্তিকে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয় না।যদিও আইনের চোখে রাষ্ট্রের ধনী-গরিব সব নাগরিকেরই সমান আইনি অধিকার পাওয়ার কথা।

সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের সুরাহা যেমন দিনের পর দিন প্রলম্বিত হচ্ছে, এ রকম অসংখ্য হত্যা, খুন, ধর্ষণের বিচার জমে আছে। ঝুলে আছে বছরের পর বছর। খুব অল্প সংখ্যক মামলারই যথাযথ নিষ্পত্তি হচ্ছে সময় মতো। বাস্তব চিত্রে আক্রমণকারী নয় বরং ভিকটিমরাই আরো বেশি করে আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। খুন হচ্ছে বা ধর্ষিত হচ্ছে মেয়ে, বাবা-মা হচ্ছে গ্রামছাড়া। বিচার চাইলে বাবা-মাসহ ভিকটিমের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নানা রকম হুমকি দেওয়ার ঘটনা এখানে নিয়মিত।

তনুর মা এক সমাবেশে অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর স্বামীকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। গতকালকের প্রথম আলো রিপোর্ট ছেপেছে তনুর মা আনোয়ারা বেগমের বরাত দিয়ে ‘সিআইডি সেনাবাহিনীর তিনজনকে যেদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে, সেদিন ওর (তনুর) বাবাকে মারার চেষ্টা করা হয়। ওর বাবার শরীরের ওপর প্রথমে গাড়ি এবং পরে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে। ওকে মারার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তনুর বাবাকে কথা বলতে না করেছে ওরা। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলি না।আমাদের পাহারা দেয় ওরা, আমরা কোনখান দিয়া আডি (হাঁটি)। আমার বড় ছেলে ভয়ে ঢাকা থেকে আসে না। মিডিয়ার সামনে কথা বললে ওরা আমাদের বাসায় থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয়। আমি বলছি, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে যাব।’

ঠিক একই রকম চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সহিংসতায় খুন হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও। যারা মরেছে গুলিতে, তাদের পরিবারের সদস্যদের নামেই মামলা হয়েছে। গ্রামশুদ্ধ লোকজনকে আসামি করা হয়েছে সে মামলায়। অজ্ঞাত তিন হাজার ২০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। যারা মরেছে তারা তো মরেছেই, যারা আছে তারা বেড়াচ্ছে পালিয়ে। পুলিশের গুলিতে খুন হওয়া আঙ্গুর আলী, জাকের আহমেদ, বাদশা মিয়া, মুর্তুজা আলী ও গোলাম আহম্মদের পরিবারও রয়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। খুনের বিচার তো হচ্ছেই না, উল্টো নানা দিক থেকে, নানা রকম হামলা মামলার ভয়ে সর্বদা তটস্ত থাকতে হয় তাঁদের।

কয়েক দফায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই যে বিপুল পরিমাণ প্রাণের সংহার হলো, তার বিচার সুরাহা হয়েছে? হবে আদৌ? এই যে খেটে খাওয়া মানুষগুলো দেখতে দেখতে খুন হয়ে গেল, এর বিচার কি পাবে তাদের পরিবার? সেইরকম বিশ্বাসের জায়গায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারেনি। জনগণকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি যে, আপনারা ভিকটিম হয়েছেন, তার ন্যায্য বিচার পাবেন। আইনের চোখে সবাই সমান। অথচ সাধারণ নাগরিকরা সর্বদাই সর্বতভাবে আইনের ওপর, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই নির্ভরতার প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ভেতর এখানে বিস্তর ফারাক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারে, বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তাটুকু না দিতে পারে, তো এই লোকগুলো যাবে কোথায়?

দিনের পর দিন এসব বিচারহীনতার সংস্কৃতি জাতীয় জীবনে কখনোই মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনবে না। বরং কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। তনুর মা যে আহাজারি করে বলেছেন- গরিব বইলা আমরা বিচার পাই না! তার সেই বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের আইনের। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর। সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের কাঁধেও এই দায়িত্ব বর্তায়।

সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চায়। অন্যায়ের বিধান চায়। অপরাধীর শাস্তি চায়। বিপদে আপদে, শঙ্কায় হুমকিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে নতজানু হয়ে ‍সুবিচার প্রত্যাশা করে। ধনী গরিব ভেদে নয় বরং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা সব অপরাধের সুষ্ঠু সমাধান রাষ্ট্রের কাছেই চায়। রাষ্ট্র এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। নির্বিচারে সব নাগরিকের সুবিচারের প্রত্যাশা পূরণ রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ