ভিন্নমত

প্রিয় নাদিয়া হুসেনকে

Looks like you've blocked notifications!
লন্ডনে পল হানসেনের তোলা ছবিতে নাদিয়া হুসেইন

২০১২ সালের আগস্টের এক রাতে আমি দেশ ছেড়েছি। তার পরদিন ঈদ ছিল। আমার মা ভীষণ কাঁদছিল। তার কান্নার কারণ ছিল, বাড়িতে কত রান্না হবে আর তার কিছুই আমি খেতে পারব না। আমার ফ্লাইট ছিল এমিরেটসে। এমিরেটস ভ্রমণের জন্য ভীষণ ভালো আর তাদের খাবারটাও ছিল মজার;অন্তত আমার ভালো লেগেছিল। তেলের মধ্যে বেগুন ডুবানো একটা কারি ছিল ওইটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল। অলিভের একটা কিছু ছিল, ঠিক মনে নেই তবে ভীষণ মজা ছিল ওটাও। তারপর এমিরেটস ডেজার্ট দিয়েছিল এবং সেখানে ছিল নানা রকমের কেক। আমি কেকের খুব ভক্ত নই, তাই ডেজার্ট খাইনি। আমার খাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল এক বাঙালি বাড়িতে। অনেক রান্না করেছিল তারা। আমি ভীষণ প্রশংসা করেছিলাম তাদের রান্নার এমনকি যেগুলো খুব বাজে হয়েছে সেগুলোরও। যে বাড়িতে খেয়েছি বাড়ির বউটি আমার চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট। তারা আমাকে দই-মিষ্টি দিয়েছিল এবং বলছিল এগুলো নাকি তারা নিজেরাই বানিয়েছে। আর এ রকম মিষ্টি তারা এখানে হরহামেশাই বানিয়ে থাকে। এই হরহামেশা ব্যাপারটি ছিল আমার কাছে অষ্টম আশ্চর্যের মতো। এই বাঙালি দম্পতির দুজনেই ছিল প্রকৌশলের ছাত্রছাত্রী। দই-মিষ্টি যখন দোকানে পাওয়া যায়, তখন এত ঝক্কি নিয়ে বাড়িতে বানানোর দরকার কী এবং যখন ওগুলো খেতে দোকানের মতো ভালো হয় না।

বাড়িতে মিষ্টি বানাতে আমার মাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। তবে অনেককেই দেখেছি শখ করে মাঝে মাঝে বানাত। মা বানাত হরেক রকমের পিঠা। আর সেগুলোর কী যে সব সুদর্শন নাম। আমার মা যে খুব বেশি রান্না জানতেন, তা নয় তবে তাতেই তিনিও অন্তত পঞ্চাশ রকমের পিঠা বানাতে জানতেন। ইংরেজিতে এসব একশো ডেজার্টের জন্য কেবল একটি শব্দই আছে, কেক। কেক ছিল আমাদের কাছে অন্য কিছু। আমাদের বাড়িতে তখন মাইক্রোয়েভ আসেনি। মা গ্যাসের চুলায় টিফিন বাটি বসিয়ে কেক বানাত। কেককে কখনো আমাদের ও রকম ডেজার্ট মনে হয়নি। আমরা জানতাম কেক খেতে হয় জন্মদিনে। কেক খেতে হয় সকালে পড়তে বসার আগে কিছু একটা খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখার জন্য অথবা বিকেলে খেলে আসার পর খুব খিদে পেলে। ঈদের দিনে আমার মা সেমাই পায়েস জর্দা বানাতেন। সেমাইটাই আবার তিনভাবে বানানো যেত। আর দোকান থেকে বাবা নিয়ে আসত মিষ্টি আর দই। ভালো খাবারের পর শেষ পাতে দই-মিষ্টি ছাড়া অন্য কিছুর কথা আমরা কোনোদিন ভাবতে পারতাম না। আমার দাদাবাড়ি ছিল প্রত্যন্ত আর সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে। শেষ পাতে দই-মিষ্টি খাওয়ার চল সেখানেও ছিল, অন্তত উৎসবের দিনে এ রকম আয়োজনের চেষ্টা থাকত তাদের।

আমাদের শহরের কালো জাম, সাবিত্রী, রসগোল্লা খুব বিখ্যাত ছিল, তবে সাবিত্রী আসত পাশের শহর মেহেরপুর থেকে। আমার বিয়ের সময় বাবা শ্বশুরবাড়িতে একটি মিষ্টি আনল, সেটা ঠিক ইলিশ মাছের পেটির মতো দেখতে, যেন হলুদ ছাড়া একটা রান্না পেটি খাচ্ছি আমি। অঞ্চল ভেদে আমাদের দেশে এত বেশি রকম মিষ্টি আর পিঠা লোকে বানায়, সেগুলোর সব নামও জানি না। আমাদের দেশের লোক ভীষণ ভোজনরসিক। আমাদের রান্নাগুলোও খুব সময়সাপেক্ষ এবং অনেক লোককে দেখলে আমার মনেই হয়েছে রান্না খাওয়া ছাড়া যেন ওদের আর কোনো কাজ নেই।

এ দেশে এসে যখন শুনেছি, এখানে ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি দোকান ছাড়া মিষ্টি পাওয়া যায় না, আমি প্রথম এক মাস ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে মিষ্টি আর দই বানানোটা অন্যদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছি। আমি খুব খারাপ রাঁধুনি নই, তবু কাঁচাগোল্লাটাই বানাতে পেরেছি শুধু কারণ আমি এমন একটা দেশ থেকে এসেছি যে দেশের মোড়ে মোড়ে হাজার পদের মিষ্টির দোকান। আর দোকানগুলো থাকায় খুব ভালো হয়েছিল, অতিথি এলে আমরা চট করে দোকানে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আসতাম। অতিথি বাড়ি থেকে না খেয়ে যাবে এটা আমরা কখনো ভাবতে পারতাম না। আর অতিথি চলে গেলে ভাইবোনদের মধ্যে সেগুলো নিয়ে হুটোপুটিও করতাম, এই হুটোপুটিটা ছিল ভীষণ মজার। আমাদের দেশের মেলাগুলোতে পাওয়া যেত কিছু শুকনো মিষ্টি; সন্দেশ, বাতাসা যদিও সেগুলোর সব নাম মনে নেই কিন্তু চোখের সামনে যেন ঠিক দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো নিয়ে হুটোপুটি করতে বেশি সুবিধা হতো আমাদের। এ দেশে ইয়োগারট পাওয়া যায়, যেটা ঠিক দই নয়, টকদই বলা যায়। আমি মাঝে মাঝে চুলের পরিচর্যায় ওটা মাথায় মেখেছি। আমি দই বানানোর ভীষণ চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হয়নি। পিঠা বানানোর চেষ্টাও করেছি, সেটাও পারিনি। আমার মা আর দাদি যে একশো পিঠা বানাত তার একটিও আজও আমি শিখে উঠতে পারিনি। আমার মাঝে মাঝে ভয় হয় আমি যদি দেশের বাইরে কোথাও কখনো স্থায়ী হয় আমার হবু সন্তানেরা হয়তো ভুলে যাবে চালের গুঁড়ো, দুধ, নারকেল-গুড় দিয়ে কী চমৎকার সব পিঠা বানানো যায়। ওরা হয়তো শুধু কেককেই ডেজার্ট মনে করবে আর আমার ছোটবেলায় খাওয়া একশ ডেজার্টের কথা ভুলে যাবে।

আমি নাদিয়া হুসেনকে আক্রমণ করতে চাই না। তার এ যাবৎকালের অর্জনকে শ্রদ্ধা করি। তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে তার অবস্থা হয়তো আমার হবু সন্তানদের মতোই হয়েছে।

লেখক :  পিএইচডি শিক্ষার্থী, তড়িৎ কৌশল, নর্থ ক্যারোলাইনা এঅ্যান্ডটি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।