খুশির উৎসব যেন পরিণত না হয় বিষাদে

Looks like you've blocked notifications!

কবি বলেছেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ কবির এই বারণ কি এখন শোনার কথা? আষাঢ়ের শেষের দিকে পড়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। প্রতিবছরের মতো সহজ কথায় বলতে গেলে ‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা’। লাখ লাখ লোক বিমান, সড়ক, নৌ বা রেলপথে ফিরবেন বাড়ি। সেখানে প্রিয়জন অপেক্ষা করছেন দীর্ঘ সময় পর স্বজনদের দেখা পাবেন বলে। এখন অবশ্য হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বা স্কাইপের যুগ। সরাসরি দেখা না হলেও ভার্চুয়াল দেখা হয়েই থাকে সারা বছর। কিন্তু প্রিয়জনের পাশে বসে থাকার মজাই যে আলাদা। আর যাঁরা এসব ভার্চুয়াল বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেননি বা জানার মতো পরিবেশও পাননি, তাঁদের জন্য তো কথাই নেই। তাই ভরা বর্ষায় বাইরে যেতে কবি যতই বারণ করুক না কেন, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে নাগরিক জীবন ছাড়বে শহরবাসী। আর এখানেই রয়েছে সতর্কতার নানা ধাপ। এবার বর্ষাকালে ঈদ হওয়ায় সেই সতর্কতা যেন আরো বেশি করে নেওয়া প্রয়োজন। 

যাঁরা আকাশপথে বাড়ি ফিরবেন, তাঁদের বিষয়টা একটু ভিন্ন। আকাশে সতর্কতা ভালো বিমানে যাওয়া। সবচেয়ে বেশি ভয় নৌপথে। বিশেষ করে গণমাধ্যম কয়েক দিন ধরে লক্কড়ঝক্কড় মার্কা নৌযান রং করা, জং তুলে ফেলাসহ মেরামতের যে দৃশ্য দেখাচ্ছে, তাতে মন আরো আঁতকে উঠছে। উৎসবের সময়গুলোতে বাড়তি চাপ থাকে নৌযানগুলোতে। স্বাভাবিকভাবে প্রচুর সংখ্যক লোক বাড়ি ফেরে। কিন্তু সে চাপের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তৈরি করে মরণফাঁদ। যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএসহ জাহাজ মালিকরা বারবার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, কোনো ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালাতে দেওয়া হবে না; ছাড়াও হবে না। কিন্তু এই আশার কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না যাত্রীরা। অতীত নৌ-দুর্ঘটনার ইতিহাস তাদের আশ্বস্ত হতে দিচ্ছে না। বিশেষ করে ২০১৪ সালে ঈদের সময় পিনাক-৬-এ প্রাণ হারিয়েছিলেন একশর বেশি মানুষ। এ ছাড়া আরো নৌ-দুর্ঘটনা তো ছিলই। অনেক নৌযান এখনো নিমজ্জিত রয়েছে বিভিন্ন নদীতে, আহত শত শত মানুষ আর সম্পদহানি তো রয়েছেই। এসবের বেশির ভাগই ঘটেছে কিন্তু অসতর্কতার কারণে। এসব অসতর্কতার মধ্যে রয়েছে, দক্ষ সুকানি না থাকা, নৌপথের নাব্য কমে যাওয়া, আবহাওয়া ও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। শেষ মুহূর্তে এসে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায় কোনো কোনো লঞ্চ। এর মধ্যে যদি এসব লঞ্চ হয় ‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ টাইপের, তাহলে তো ডুবতে বাধ্য। তাই শুধু আশ্বাস নয়, সতর্ক থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে, যাতে ঘাট থেকে ছাড়ার আগেই ফিটনেসবিহীন লঞ্চ আটকে দেওয়া যায়। 

রেলপথে টিকেট পাওয়া যায় না, কিন্তু সারা বছর শোনা যায় এই খাতে লোকসান। এর কারণ, অসাধু কর্মচারীরা। রেলে টিকেট না করালেও ভেতরে টিটি বা কর্মচারীদের হাতে অল্প টাকা গুঁজে দিয়ে সহজে পার পাওয়া যায়। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু ঈদে এসে যাত্রীর চাপ এমনই বেড়ে যায়, সংবাদপত্রের পাতা বা দৃশ্যমান মাধ্যমে কিছু কমন দৃশ্য চোখে পড়ে, কষ্ট করে ট্রেনের জানালা দিয়ে ওঠা, ছাদে ওঠার জন্য একজন আরেকজনকে ঠেলে দেওয়া, দূর থেকে ধারণ করা যে দৃশ্যটি আঁতকে ওঠার মতো সেটি হলো, ট্রেন চলছে আর ইঞ্জিন থেকে শুরু করে ছাদ—সব জায়গায় মানুষ আর মানুষ। ট্রেনের প্রতিটা বগির বাইরে যদি দাঁড়ানোর জায়গা থাকত, সেখানেও লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। এসব ঝুঁকি নিয়েই যাত্রা ট্রেনের। দেখার কেউ নেই। যদিও প্রতিবছর নতুন বগি সংযুক্ত হয়। (এবার সোনার বাংলা নামে একটি নতুন ট্রেনও উদ্বোধন হলো) বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু হয় এরপরও কমছে ট্রেনযাত্রার এই বিসদৃশ্য দৃশ্য।

প্রতিদিন অপমৃত্যুর মিছিলে যোগ হওয়া মানুষগুলোর বেশির ভাগই সড়ক দুর্ঘটনার কারণে হয়ে থাকে। আর দৃশ্যটা এমন যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, সেদিন একটার পর একটা এমন সংবাদই আসে। ঈদে সে খবর পাওয়া যায় আরো বেশি। তার কারণই লঞ্চের মতো, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি। বিশেষ করে ঈদের সময় সাধারণ অনেক পরিবহনও চলাচল শুরু করে মহাসড়কে। সে কারণে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। আর রাস্তার কারণে তো ঘটছেই দুর্ঘটনা। ভরা বর্ষায় রাস্তার ওপর ঈদের যাত্রীবাহী গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে এবারে ভয়টা আরো বেশি। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এবারে সড়কের কারণে কোনো যানজট বা দুর্ঘটনা হবে না।’ কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারছি কোথায়! খোদ রাজধানী থেকে বের হওয়ার পথেই তো বাধা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের ১১ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলমুখী লাখ লাখ লোক এই পথ দিয়ে রাজধানী ছাড়বে। ২০১৩ সাল থেকে এই রাস্তার সংস্কারকাজ শুরু করলেও এখনো তা শেষ হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, সড়কে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে টেকসই মেরামত হচ্ছে না। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে এখনো চলছে পিচ ঢালাইসহ নানা সংস্কারকাজ। বর্ষার কারণে এসব এলাকা দিয়ে যান চলাচলেও সমস্যা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাহী আদেশে ১ জুলাই থেকে টানা নয় দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছেন। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের। তাই অনেকে আগেভাগে ছাড়তে শুরু করেছেন রাজধানী। টিকেটের জন্য দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে না আর। কিন্তু নিজের বাড়িঘর নিরাপদে থাকবে তো। এই শঙ্কা থেকে যাচ্ছে শহরবাসীর। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, জোর দেওয়া হচ্ছে নিজেরাও যাতে নিরাপত্তা নিয়ে সজাগ থাকে। সেটা পরের বিষয়। তবে এ কথা ঠিক যে অনেকে, গৃহকর্মী বা বয়স্ক লোকদের বাড়িতে আটকে রেখে গ্রামে ঈদ করতে যান। কতটা অমানবিক আর নিষ্ঠুর হলে এই কাজ করা যায়, সেটা ভেবে দেখা দরকার। কেউ চায় না অঘটন। একটি ছোট দুর্ঘটনা শেষ করে দিতে পারে ঈদের আনন্দ। শুধু ঈদ কেন, সেটি হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। তাই কান্না নয়, খুশির ঈদ খুশিতেই কাটুক, তা যেন বিষাদে পরিণত না হয়। 

লেখক : সাংবাদিক