কলকাতার জার্নাল
কলকাতা কার ফুটবল না ক্রিকেটের?
কলকাতা-ক্রিকেট না ফুটবলের? এ চলমান এক বিতর্ক। দিন শেষে সত্যিই বলা কঠিন, কলকাতা কার। তবে একটা কথা সত্য, কলকাতা এখন আর ভারতীয় ফুটবলের রাজধানী নেই। ভারতীয় ফুটবলে কলকাতার সেই আধিপত্য, দাপট কমেছে অনেক। তবে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনায় খুব বেশি ভাটা পড়েছে তা বলা যায় না। মোহন বাগান, ইস্ট বেঙ্গল, মোহামেডান নিয়ে মাতামাতি হয়তো কমেছে কিছুটা। কিন্তু রেষারেষিটা ঠিকই রয়ে গেছে। কলকাতার ময়দানে এখনো এই তিন দলের লড়াই মানে মযার্দার লড়াই। তবে কলকাতার ফুটবল মর্যাদা আর আভিজাত্যে নতুনভাবে যোগ হয়েছে ‘অ্যাটলেটিকো দ্য কলকাতা’। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের অন্যতম সেরা দল। কলকাতার ফুটবলানুরাগী মানুষের আবেগের নতুন জায়গাও এখন অ্যাটলেটিকো দ্য কলকাতা। আর সেই আবেগ আরো বেড়ে গেছে দলটার সঙ্গে যখন জড়িয়ে আছে সৌরভ গাঙ্গুলির নাম।
তাহলে কলকাতার ধমনি থেকে কি ক্রিকেটীয় রক্ত নিঃশেষিত হয়ে গেছে? ভুল। তেমনটা ভাবলে মস্ত বড় ভুল হবে। আইপিএলের গায়ে যখন বিজ্ঞাপনের ভাষায় এঁটে দেওয়া হয়েছে; ‘ইন্ডিয়ার উৎসবে’র ট্যাগ তখন সেই উৎসবের সবচেয়ে বড় মঞ্চ মনে হচ্ছে কলকাতা। ইডেনের গত দুটো ম্যাচে গ্যালারির দিকে তাকালে আপনাকে বলতেই হবে; ভারতে ক্রিকেট মানে কলকাতা। হ্যাঁ, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাইয়ের নাম মাথায় রেখেও তা লিখতে হবে। আর সেটা একজন বিসিসিআই সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া কিংবা ভারতের একজন সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কারণে নয়। বলতে হবে এই কলকাতার ক্রিকেট প্রজ্ঞা-সমৃদ্ধ দর্শকদের কারণে। সেটা টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি কিংবা ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট আইপিএল হোক, কলকাতার দর্শক তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেন ইডেনে। আইপিএল এইটে কলকাতা নাইট রাইডার্স বনাম মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স এবং কলকাতা নাইট রাইডার্স বনাম রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সত্তর হাজারের বেশি দর্শকভর্তি ইডেন। কেকেআর বলে চিৎকার চারিদিকে। আবার প্রতিপক্ষের কোনো ব্যাটসম্যানের একটা ভালো শটকেও সমান তারিফ করছে। এটা বোধহয় শুধু কলকাতার দর্শকদের পক্ষেই সম্ভব। সে কারণেই কলকাতা এগিয়ে থাকছে ভারতের অন্য যে কোনো মাঠের চেয়ে। আর আইপিএলে সেই গ্যালারির আকর্ষণ আরো বেড়ে যায় বলিউড তারকা এবং কেকেআরের মালিক শাহরুখ খানের উপস্থিতিতে। দর্শকদের তাতিয়ে তুলতে অন্যরকম এক উদ্দীপকের নাম শাহরুখ। তবে কলকাতার মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় উদ্দীপক ক্রিকেট।
আর এই ক্রিকেটের টানে কলকাতায় কত বলিউড তারকা বারবার উড়ে এসেছেন। কলকাতা ‘ক্রিকেট-বলিউড’ অনেক রোমান্সের পটভূমি। মনসুর আলী খান পতৌদি-শর্মিলা ঠাকুর জুটির কথা যদি বাদও দেন, তারপরও অনেক গল্প থাকবে। যার জন্ম কলকাতায়। এবং এর সবশেষ সংযোজন বিরাট কোহলি-আনুশকা শর্মা। এই কলকাতায় দাঁড়িয়ে বিরাট কোহলি জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন,‘ আমি আনুশকার পাশে আছি।’ এর পরদিনই আনুশকা আবার ছুটে এলেন কলকাতায়। সুনীল গাভাস্কারের মতো লোকও বিরাট কোহলিকে জিজ্ঞেস করলেন; ‘সে কি এখানে?’ ‘আসার তো কথা’- বিরাটের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতেই ইডেনে হাজির আনুশকা। এবং তিনিও কলকাতায় এসে বুঝিয়ে দিলেন বিরাটের পাশেই আছেন। বিরাট কোহলি বড় রান না করলেও সেই ম্যাচ জিতে নেয় তার দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার বেঙ্গালুরু। এবং সেটা ক্রিস গেইল ঝড়ে। তার রেশটা এখনো কলকাতার ক্রিকেট মহলে।
ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে তর্ক-যুক্তি-পাল্টা যুক্তি আছে কলকাতায়। তবে একটা বিষয় নিয়ে এখন আর কেউ কথা বলেন না। শহর কলকাতার হৃৎপিণ্ডের দুই অলিন্দ হচ্ছে ইডেন গার্ডেন আর যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গন। ক্রিকেট আর ফুটবলের উন্মাদনা, উত্তেজনা ভালোভাবেই টের পাওয়া যায় এই দুটো মাঠে ম্যাচ থাকলে। সেটা কে কে আরের ক্রিকেট কিংবা অ্যাটলেটিকো দ্য কলকাতার ফুটবল যাই হোক। খেলা প্রিয় সেই কলকাতার আগামী দিনের চেহারাটা কেমন হবে তা নিয়ে এখন চলছে আলোচনার ঝড়। লন্ডন না প্যারিস কী রূপ নেবে কলকাতা? ইউরোপের ওই দুটো শহরের মাঝখানে দূরত্ব তো মাত্র একটা টানেল। কিন্তু আলোচনার টানেল পেরিয়ে কোন পাড়ে জায়গা নেবে কলকাতা, সেটা এখনো জানেন না এখানকার মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপ্যাধায় একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন কলকাতাকে লন্ডন বানানো হবে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ফ্রান্স সফরে সে দেশের সরকার ভারতে বিনিয়োগের যে বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তার একটা হচ্ছে স্মার্ট সিটি প্রকল্প। আর সেই প্রকল্পের মধ্যে তারা রাখতে আগ্রহী শহর কলকাতাকে। সংস্কার করে প্যারিসের রূপ দিতে চায় কলকাতাকে। ব্রিটিশ নির্মাণের নিদর্শনের পাশাপাশি কলকাতায় রয়েছে সমকালীন নগর ব্যবস্থার ছোঁয়াও। নগর বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলে থাকেন, ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধন রয়েছে কলকাতায়। ব্রিটেনের সঙ্গে কলকাতার ইতিহাস জড়িয়ে। আর ফ্রান্সের সঙ্গে কলকাতার রয়েছে একটা আত্মিক যোগাযোগ। শেষ পর্যন্ত কোন দিকে ঝুঁকবে কলকাতা? ইতিহাস, নাকি আত্মিক যোগাযোগের দিকে। এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর বেরিয়ে এসেছে কলকাতার ক্রীড়া মহল থেকে; লন্ডন কিংবা প্যারিস যার সিস্টার সিটি-ই হোক না কেন কলকাতা, সে থাকবে তার স্বকীয়তায়। ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে এ রকম বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস পৃথিবীর আর কোনো শহরে আছে!
শেষ বাক্যটা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, আছে। আরো একটা নাম- ঢাকা।