শিল্পীর জন্য

লাকী আখন্দ আবারো গাইবেন আমাদের জন্য

Looks like you've blocked notifications!

বিশ্ব মানবতার জয়গান গাইতে গিয়ে যুগশ্রেষ্ঠ হাজারো সোনার মানুষ শিল্পকে মনে প্রাণে ধারণ করেন। সব বাধাকে জয় করার ব্রত নিয়ে বেছে নেন নান্দনিক সৌন্দর্য চর্চার পথ। শ্রোতার বিক্ষিপ্ত মনকে যথাস্থানে সন্নিবেশ করতে নিজের গায়কী বা সঙ্গীতকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন অনেকেই। তেমনি একজন শিল্পী লাকী আখন্দ। জীবনের শেষ বেলায় ভয়াল ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালের চার দেয়ালে বন্দি এই প্রথিতযশা শিল্পী।

শিল্পীরা বড়ই ভাগ্য বিড়ম্বিত হন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশির ভাগ শিল্পী মানুষকে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এক অসহায় নিয়তির কাছে নিজেকে সমর্পিত করতে দেখা যায়। তাঁদের ওপর বিবেকবান মানুষ অথবা রাষ্ট্রের নজর পড়ে না যতক্ষণ পর্যন্ত না নিরুপায় সেই মানুষরা হাত বাড়িয়ে কিছু যাচনা করেন। আমরা যারা বিত্তের সমুদ্রে হাবুডুবু খাই অথবা যাদের অর্থ অপাত্রে বা অস্থানে উপচে পড়ে সকাল-বিকেল, তারাও এই বিব্রত শিল্পী বা তাদের পরিবারের দিকে নজর দেওয়ার জরুরত বোধ করি না। অথচ এই শিল্পীরা একদিন শত দুঃখ-শোককে জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের সুর সুধায় আমাদের কিংবা আমাদের পূর্ব প্রজন্মকে আনন্দের সুখ সায়রে পরিভ্রমণ করিয়েছেন। আমরা এখন এতটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি যে, শিল্পের ঋণ বা শিল্পীর প্রতি আমাদের কোনো দায় স্বীকার করি না। দরদও বোধ করি না। আমরা কীভাবে ভাবতে পারি অথবা মেনে নিতে পারি, ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা ও গুণী শিল্পীর চিকিৎসা সংকট চরমে উঠতে পারে সামান্য অর্থের জোগান না থাকায়? লাকী আখন্দের বেলায় তেমনটাই ঘটছে। অথচ মানুষের প্রতি মানুষের দায়বোধ মনে করিয়ে দিতেই প্রয়াত শিল্পী ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন,

বল কি তোমার ক্ষতি

জীবনের অথৈ নদী

পার হয় তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি!

মানুষ মানুষের জন্য

জীবন জীবনের জন্য

একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না

ও বন্ধু ...   

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আশির দশকে লাকী আখন্দ অসংখ্য কালজয়ী গানের সুর করেছেন এবং নিজেই গেয়েছেন। ‘আমায় ডেকো না, ‘এই নীল মনিহার’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘মামনিয়া’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’, ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’, ‘কি করে বললে তুমি’, ‘এত দূরে যে চলে গেছ’ গানগুলো নিজে গেয়েছেন কিংবা সমকালীন অপরাপর খ্যাতিমান শিল্পীদের কণ্ঠে তুলে দিয়েছেন। সেসব সুরামৃত এখনো আমাদের বিমোহিত করে রাখে। এমন একজন মহান শিল্পী সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সরকারের সহযোগিতা পেলে ভালো হয়। আমি আমার ভক্ত ও সরকারের কাছে চিকিৎসা সহায়তা চাইছি।’

এর আগে লাকী আখন্দ বলেছিলেন, উনার চিকিৎসার জন্য তিনি কারো কাছে হাত পাতবেন না। তিনি উনার গানের মেধাস্বত্ব চান। সেই শিল্পীকেই কি না এখন নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ভক্তের দ্বারে কড়া নাড়তে হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিব্রত শিল্পীর কন্যা মাম্মিন্তি বলেছেন, ‘বিষয়টা নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। দু-একটা মিডিয়ায় এই ধরনের সংবাদ প্রচার হয়েছে। খুব বেশি প্রচার চাইছি না। আপাতত আমরা বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত আছি। বেশ কিছুদিন ধরে উনার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ।

গত বছর লাকী আখন্দ গুরুতর অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে চিকিৎসকরা ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্ত করেন। এরপর ঢাকা থেকে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চিকিৎসায় পাঁচ লাখ টাকা অর্থ সহায়তাও দেন। বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এই শিল্পী।

এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী লাকী আখন্দ একাধারে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার ও গীতিকার। ১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে প্রথমবারের মতো একক অ্যালবাম বের করেন লাকী আখন্দ। ওই অ্যালবামের ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘রীতিনীতি জানি না’, ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘সুমনা’র মতো গান তখন শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ১৯৮৭ সালে ছোট ভাই ‘হ্যাপী আখান্দের’ মৃত্যুর পরপর সঙ্গীতাঙ্গন থেকে অনেকটাই স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেন এই গুণী শিল্পী। মাঝখানে প্রায় এক দশক নীরব থেকে লাকী আখন্দ ১৯৯৮ সালে ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবাম দুটি নিয়ে এই শিল্পী শ্রোতাদের মাঝে আবারও ফিরে আসেন। সর্বশেষ নিজের মেয়ে মাম্মিন্তিকে বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রামে নিজের উত্তরসূরী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লাকী আখন্দ।

এই গুণী শিল্পীর উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া ছাড়া এখন আর অন্য বিকল্প নেই। এজন্য দরকার মোটা অঙ্কের অর্থ। যে ব্যয়ভার শিল্পীর একার পক্ষে বহন করা অসম্ভব। তাই শিল্পী লাকী আখন্দের জন্য প্রসারিত হোক আপনার মানবিক হাত। সবার সহৃদয় সহযোগিতায় লাকী আখান্দ আবার স্বরূপে ফিরে আসুন আমাদের মাঝে। তিনি আবার ভোরের পাখি হয়ে ঘুম ভাঙ্গানিয়া গান শোনাক। মানবতার জয় হোক।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন