এক্সট্রা কাভার

বেনো, ক্রিকেট ধারাভাষ্যের ব্র্যাডম্যান

Looks like you've blocked notifications!

রিচি বেনো। ক্রিকেটার হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? উত্তরের জন্য হয়তো পরিসংখ্যানের পাতা একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে হতে পারে। তারপর যা পাওয়া যাবে; তাতে জানা যাবে তিনি ছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম অলরাউন্ডার যিনি টেস্টে ২০০০ রান আর ২০০ উইকেটের ডাবল অর্জন করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৬৩ টেস্ট খেলেছেন। অধিনায়কত্ব করেছেন ২৮ টেস্টে। অবসর নিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। এই সব সংখ্যার মাঝে একজন রিচি বেনোকে আটকে রাখা যায়নি। রাখার চেষ্টাও কেউ করেননি। কারণ, ক্রিকেট থেকে অবসরোত্তর জীবনে তিনি নিজেকে এমন এক স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে ক্রিকেট  শব্দটা আর  রিচি বেনো হয়ে গিয়েছিলেন সমার্থক।

 

ক্রিকেট ধারাভাষ্যকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাকে বলা যেতে পারে ধারাভাষ্যের শেষ কথা, একেবারে শিল্প। একটু অন্যভাবে বললে বলতে হবে; ক্রিকেট ধারাভাষ্যে তিনিই ছিলেন ‘ডন ব্র্যাডম্যান’। কয়েকদিন আগে চিরতরে থেমে গেছে সেই কণ্ঠস্বর। চুরাশি বছর বয়সে চিরনিদ্রায় চলে গেছেন ‘ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর’। বেনোর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে যায় ক্রিকেট বিশ্ব। শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ক্রিকেট গ্রহ। শোকের আস্তরণ সরিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ক্রিকেটবিশ্ব। লেগ স্পিনের অন্যতম পথিকৃত, কিংবদন্তি অলরাউন্ডার, অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন। এই শব্দগুলোর পাশে এসে অনেকেই দাঁড়িয়েছেন। আগামীতেও দাঁড়াবেন। বেনোর জায়গাটা হয়তো ভরাটও করবেন। কিন্তু কিংবদন্তি ক্রিকেট ভাষ্যকার বেনোর অভাব পূরণ করবেন কে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো। এখন যাঁরা ক্রিকেটের কমেন্ট্রি বক্স দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরাও কেউ বলতে পারছেন না। এবং বেনোর মৃত্যু তাঁদেরও দারুণভাবে আহত করেছে। কলকাতায়  আইপিএলের ধারাভাষ্য দিতে এসে রবি শাস্ত্রী বলছিলেন; ‘এই উপমহাদেশে  রিচি কমেন্ট্রি করলে ক্রিকেট আরো বেশি লাভবান হতো। তবে তাঁর মৃত্যুতে ক্রিকেট ধারাভাষ্য নিঃস্ব হয়ে গেল!’ রবি এতটাই শোকাহত ছিলেন, যে ভুলেই বসলেন রিচি বেনো এই উপমহাদেশে কমেন্ট্রি করেছেন। রবি  নিজেই তাঁর সঙ্গে মাইক্রোফোন ভাগাভাগি করেছিলেন। এবং সেটা ’৯৬-এর বিশ্বকাপে।

আসলে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর ক্রিকেটের দ্বিতীয় ইনিংসে এত বর্ণময় ছিলেন রিচি বেনো যা শুধু তাঁর প্রজন্মকে নয়, পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে মুগ্ধতায় ভরে রেখেছে। ক্রীড়া সাংবাদিক এবং ধারাভাষ্যকার হিসেবে তিনি পৌঁছেছিলেন সাফল্যের শিখরে। যেখানে অন্যদের পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মিডিয়া বক্সেও ‘হল অব ফেমে’ তাঁর নামটা রয়েছে অনেক ওপরে। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের কমেন্ট্রি বক্সে বাঁধাই করা রয়েছে তাঁর ডিজিটাল পোর্ট্রেট। কিন্তু এখন নেই শুধু বেনো। বোনো হীন ক্রিকেট কমেন্ট্রি বক্স ক্রিকেট নামক খেলাটার অঙ্গহানি মনে হয়! যদিও স্কিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে সরাসরি কমেন্টি বক্স থেকে আর কমেন্ট্রি করেননি তিনি। তবু বাড়ি থেকে অ্যাশেস সিরিজে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কমেন্ট্রি করেছেন তিনি। বিসিসি আর চ্যানেল নাইনের হয়ে বেশি কমেন্ট্রি করেছেন তিনি। ২০০৫ সালে সরাসরি কমেন্ট্রি থেকে সরে যান তিনি। প্রত্যক্ষ ধারাভাষ্য দেননি তিনি সেই সময় থেকে। কিন্তু চ্যানেল নাইনের হয়ে কাজ করে যান ২০১৩ পর্যন্ত।

 শব্দ চয়ন। কথা বলার ধরন। ক্রিকেট প্রজ্ঞা। রসবোধ। সব মিলিয়ে ধারাভাষ্যে রিচি বেনো নিজস্ব এক ঘরানা তৈরি করেছিলেন। যে ঘরনার একমাত্র প্রতিনিধিও তিনি। কমেন্ট্রি বক্স থেকে ক্রিকেটপ্রেমীর ঘরে ক্রিকেটের ছবিটা এমনভাবে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি, যেটা না পেয়ে এখন ক্রিকেটকেই খানিকটা নিঃস্ব মনে হতে পারে অনেকের কাছে। আর সেটা কেউ মনে করলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, ক্রিকেট ধারাভাষ্যে বেনোর বেঞ্জমার্ক অতিক্রম করার কেউ নেই।

রিচি বেনো কি শুধু ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে খুব বড় ছিলেন? দূর থেকে মানুষগুলোর কাছে তেমনটা মনে হতেও পারে। কিন্তু যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা তো অন্য কথা বলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক যেমন শোক সামলে উঠে বলেছেন, ‘আমাদের গোটা প্রজন্ম বড়ই হয়েছে ওই গলার আওয়াজ শুনে। গ্রেট ক্রিকেটার। গ্রেট ক্যাপ্টেন। হারকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। ভালোবাসতেন জিততে। নিজে জিতেছেন। আমাদের শিখিয়েছেন জেতার জন্য মানসিকতা ঠিক কী রকম হওয়া উচিত। তবে সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। যিনি বিশ্বাস করতেন ক্রিকেটের শুভ্রতায়।’ সেই লোকটা চিরনিদ্রায় গেলেন পরম শান্তিতে। ঘুমের মাঝেই চলে গেলেন! তারপর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নকে হারালাম না, হারালাম দেশের সেরা আইকনকে। জীবন নামক অসাধারণ ইনিংস শেষে প্যাভিলিয়নে শান্তিতেই বিশ্রাম নিন বেনো।’

কমেন্ট্রি বক্সটাকে শূন্য করে বেনো গেলেন জীবনের ২২ গজের অন্যপ্রান্তের প্যাভিলিয়নে। তাঁর এই চলে যাওয়ার পর সেরা ক্যাচটা লাইনটা এলো লেগ স্পিনে বেনোর সেরা উত্তরাধিকারী শেন ওয়ার্নের কাছ থেকে। ‘সব কিছুর আগে রিচি ছিলেন প্রকৃত ভদ্রলোক। যিনি অসাধারণ হয়েও সাধারণের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’ এবং সে কারণেই কি অস্ট্রেলিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর শেষকৃত্যও আয়োজন করতে চাইলেও পরিবার থেকে বলা হলো  ‘না’! অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকল বটে। কিন্তু ব্যক্তি বেনো তাঁর ব্যক্তিত্বের পতাকাকে আরো উঁচুতে তুলে রেখে গেলেন মৃত্যুর পরও!