এক্সট্রা কাভার

পাল্টে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মানচিত্রও

Looks like you've blocked notifications!

পরিবর্তনের স্লোগান এখন চারিদিকে। নির্বাচনী হাওয়ায় পরিবর্তনের স্লোগানটা একটু বেশি শোনা যাচ্ছে। কেউ পাল্টে দিতে চান ঢাকা উত্তরের চেহারা। কেউ বদলাতে চান দক্ষিণকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট মানচিত্রে শহর ঢাকা বদলে গেছে অনেক আগে। স্লোগান ছাড়া, অনেকটা নীরবে! আর এমনভাবে বদলাতে শুরু করল, যা দেখে অনেকে একসময় বলতে শুরু করেছিলেন; এভাবে চলতে থাকলে থেমে যাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের  হৃৎপিণ্ড! আবার বেঁচে থাকলেও ভুগবে রক্তস্বল্পতায়! সেই আশঙ্কাটা যে একেবারে অমূলক ছিল, তাও বলা যাবে না। কারণ, ঢাকা-ই ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণকেন্দ্র। অনেকে হয়তো চমকে উঠবেন ‘ছিল’ শব্দটা পড়ে! প্রশ্ন জাগতে পারে; তাহলে কি এখন নেই?

আছে। কাগজে-কলমে এখনো ঢাকাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণকেন্দ্র। ‘হোম অব ক্রিকেট’ বলে যা কিছু শোনা যায়, তা তো এই ঢাকায়। টেস্ট বলুন, ওয়ানডে বলুন সবই প্রায় ঢাকাতেই হয়। দু-একটা চট্টগ্রামে। আর তা না হলে খুলনায়। একসময় অবশ্য দু-একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ বগুড়াতেও হয়েছে। তাহলে ক্রিকেটের শহর ঢাকা বদলাল কীভাবে? ঢাকা তো থাকল ঢাকাতেই।

না। ঢাকা মোটেও আর সেই ঢাকা নেই। এই ঢাকা এখন ক্রিকেটের জন্য এক অনুর্বর জমিন! ঢাকা এখন আর জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার মতো ক্রিকেটার দিতে পারে না! অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম জাতীয় দলটার প্রথম একাদশের আট-নয়জন ক্রিকেটারই ছিলেন ঢাকার। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হবে; পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন তাঁরা। এরপর পেরিয়ে গেল চার দশক। অনেক কিছু বদলে গেছে ঢাকার। শহর ঢাকার গায়ে কোথাও কোথাও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আকাশছোঁয়া স্থাপনা হয়েছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে ঢাকার মাঠগুলো। পল্টন ময়দান এখন আর ময়দান নেই; যে ময়দানের পাশে একটা স্টেডিয়াম তৈরিই হয়েছিল ক্রিকেটের জন্য। পাকিস্তান-ভারত টেস্ট ম্যাচ দিয়ে সেই ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি যে স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক অভিষেক, সেই স্টেডিয়াম এখন ক্রিকেটের কিছু স্মৃতি আর পরিসংখ্যানকে বুকে নিয়েই বেঁচে আছে। এখন আর সেখানে ক্রিকেট হয় না! পল্টন ময়দানে ক্রিকেট ম্যাচ কেন, প্র্যাকটিস করার জায়গাটুকুও নেই! সেই ঢাকায় ক্রিকেট থাকে কীভাবে?

সত্যিই ঢাকায় এখন ক্রিকেট নেই। আর নেই বলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে শহর ঢাকার সেই আধিপত্য, দাপট বলে কিছু নেই! এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে দলটা খেলল কিংবা যে দলটা পাকিস্তানকে সাদাধোলাই দিয়ে বর্ণহীন করে দিল, সেই দলটাকে যদি বিশৈল্য কাটাছেঁড়া করেন, তার মাঝেই শহর ঢাকার ক্রিকেটীয় কঙ্কালটা খুঁজে পাবেন। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বাংলাদেশও এখন টেস্ট ওয়ানডেতে আলাদা অধিনায়ক বানিয়েছে। তাদের ডেপুটিও আলাদা। ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তাঁর ডেপুটি সাকিব আল হাসান। প্রথমজন নড়াইল নামক ছোট একটা জেলা থেকে উঠে এসেছেন। মাশরাফির আগে যে শহরকে ক্রিকেট দিয়ে কেউ চিনত না। বরং চিনত একঝাঁক টেবিল টেনিস তারকার সৌজন্যে। অন্যজন সাকিব আল হাসান। এখন ক্রিকেটবিশ্ব যাঁকে এক নামেই চেনে। কিন্তু তাঁর শহর মাগুরাকে ক্রিকেট মানচিত্রে খুঁজে বেড়ানোর প্রয়োজনও মনে করে না কেউ। ছোট। খুবই ছোট একটি শহর। যে শহরের পরিচয়ে এখন সাকিব আল হাসান সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। শহর ব্র্যান্ডিংয়ের কালচারটা এখনো বাংলাদেশে চালু হয়নি। হলে মাগুরার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডিং হতে পারেন সাকিব আল হাসান। আইসিসি র‍্যাংকিংয়ে লম্বা সময় ধরে যিনি টেস্ট-ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই অলরাউন্ডারদের শীর্ষে ছিলেন। তিনি এখন মাগুরার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। টেস্টে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। উঠে এসেছেন বগুড়া থেকে। ছোটখাটো এই ক্রিকেটার এখন বাংলাদেশ দলের মিস্টার কনসিসটেন্ট। ধারাবাহিকভাবে দারুণ সফল উইকেটের সামনে এবং পেছনে। তাঁর ডেপুটি তামিম ইকবাল। লর্ডসের রোল অব অনার বোর্ডে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যিনি নাম তুলেছেন সেঞ্চুরি করে। যাঁর  ক্যারিয়ারের খারাপ সময় যাচ্ছে বলতে বলতেও যিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে টানা দুটো সেঞ্চুরি করলেন! তিনি ‘প্রিন্স অব চিটাগং’। তাহলে ঢাকা? বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো ক্রিকেটার তার নেই! বড় শহর ঢাকার নেই কোনো বড় তারকা ক্রিকেটার!

পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে যিনি আলো ছড়ালেন ব্যাট হাতে, সেই সৌম্য সরকারের উঠে আসা সাতক্ষীরা নামক সীমান্তঘেঁষা ছোট এক শহর থেকে। অথচ দিনে দিনে বড় ইনিংস খেলতে শুরু করেছেন এই বাঁহাতি তরুণ। বিশ্বকাপে যাঁর ব্যটিং নজর কেড়েছিল বিশেষজ্ঞদের। আবার একই সঙ্গে আক্ষেপ বাড়িয়েছিল, এত ভালো ব্যাটিং করেন অথচ বড় ইনিংস আসছে না! সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিলেন তিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত সেঞ্চুরি করে। ‘সৌম্য’ নামটার শাব্দিক অর্থ যদি হয় শান্ত, তাহলে মাঝখানের ২২ গজে তাঁর মতো ঔদ্ধত্য দেখানো ব্যাটসম্যান বাংলাদেশ দলে কমই আছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ছোট শহর সাতক্ষীরাকে চেনানোর সেরা লোকটার নাম এখন সৌম্য সরকার। আর বিজ্ঞাপনের ছবিতে যিনি এখন বলে বেড়াচ্ছেন; স্টাম্প ভেঙে দেবেন বাংলাদেশ দলের সেই ফাস্ট বোলারের উঠে আসা একই অঞ্চলের আরেক শহর বাগেরহাট থেকে। বিশ্বকাপে যাঁর বোলিং বড় বড় ব্যাটসম্যানের মেরুদণ্ড দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে অনেক কারণেই আলোচনায় এখন রুবেল হোসেন। সে কারণে আলোচনায় উঠে আসে তাঁর শহর বাগেরহাটও। রুবেলের আগে যে শহর ঠিক ক্রিকেটের কারণে এতটা পরিচিতি পায়নি কখনো।

সৌম্য-রুবেল-বিজয়-মুমিনুল-আবুল হোসেন রাজু-সাব্বির রুম্মন-নাসির হোসেনরা উঠে এসেছেন খুব ছোট ছোট শহর থেকে। কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে পরপর দুই ম্যাচে দুটো সেঞ্চুরি করলেন, যিনি সেই মাহমুদউল্লাহর উঠে আসা অবশ্য ক্রিকেটীয় ঐতিহ্যে সম্মৃদ্ধ এক শহর ময়মনসিংহ থেকে। অখণ্ডিত বাংলায় ক্রিকেটের পথচলার অনেক ঘটনার সাক্ষী ময়মনসিংহ। কিন্তু সেই শহরও হারিয়েছে তার ঐতিহ্য! মাহমুদউল্লাহ এখন বাতিঘরের মতো জ্বালিয়ে রেখেছেন ময়মনসিংহের ক্রিকেটীয় আলোটা!

তাহলে শহর ঢাকা? তাসকিন আর আরাফাত সানি আমাদের। এমন একটা দাবি করতেই পারে ঢাকা। মোহাম্মদপুরের ছেলে তাসকিন। দুর্দান্ত বল করছেন। উঠতি ফাস্ট বোলার। হয়তো আরো অনেক দূর যাবেন তিনি। আর আরাফাত সানি  উঠে এসেছেন ঢাকার আমিন বাজার থেকে। নগর ঢাকার আভিজাত্য আর পরিপাটি তাঁকে সেভাবে ছুঁয়েছে তেমন দাবি তিনি নিজেও করেন না। বাংলাদেশ দলের ১১ জনের মধ্যে দুজনের বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না শহর ঢাকা থেকে! সত্যিই বদলে গেছে ঢাকার ক্রিকেট। বদলে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মানচিত্র। ছোট ছোট শহর থেকে এখন উঠে আসছেন বড় বড় তারকা! আর এঁদের উঠে আসার গল্পটা প্রায় একই রকম। যদিও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে হয়তো একই প্রেক্ষাপট থেকে এঁরা উঠে আসেননি। তবে  এঁদের উঠে আসার আকাঙ্ক্ষার স্তরটা একই।