জাতীয় সংলাপ শুরু করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে

Looks like you've blocked notifications!
ড. কামাল হোসেন

অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। যে লক্ষ্য ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, তা ছিল শোষণ-বঞ্চনা-ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত কল্যাণমুখী অর্থনীতি, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতি, কার্যকর সংসদ, স্বশাসিত শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ, দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ ও জনপ্রশাসন এবং জনগণের পূর্ণ ক্ষমতায়ন, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। 

বর্তমানে সারা দেশে রাজনৈতিক যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তার জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ সমাধান। গণতান্ত্রিক দেশে বোমাবাজি ও সহিংসতা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। সাধারণ মানুষ বোমাবাজি, সহিংসতা যেমন পছন্দ করছে না, আবার সরকারের এক নায়কতান্ত্রিক আচরণও মেনে নিতে পারছে না। তাই সংকট নিরসনে সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানে হতে পারে। তবে নামে মাত্র সংলাপ হলে হবে না, হতে হবে সংস্কারমূলক। আমি মনে করি, ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ।   

স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যা প্রকৃত অর্থেই হবে গণতান্ত্রিক; যার প্রতিটি স্তরেই জনগণের ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত হবে। জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হবে এবং জনগণ সে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। অর্থ, অস্ত্র ও পেশিশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন এবং জনগণের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবেন। 

বহুদলীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় ও জনস্বার্থে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সে ভূমিকা পালন করতে হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থকে প্রশ্রয় না দেওয়া, জনগণের অধিকার ও স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতি ও উন্নয়ন যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে সরকারকে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশনসহ সাংবিধানিক সংস্থাগুলো যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, ক্ষমতাসীন সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

এর জন্য প্রয়োজন স্বার্থ ও দলীয় আনুগত্য বিবেচনা না করে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দান সুনিশ্চিত করা। 

গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আইনের দৃষ্টিতে সবার জন্য সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সাংবিধানিকভাবেও স্বীকৃত। তাই শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারকে এসব বিষয়ের প্রতি অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলই আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে পারে না। নির্বাহী বিভাগ, ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমেই আইনের শাসন সুনিশ্চিত হতে পারে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ কার্যক্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব। সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা, বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য ও আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারকে প্রভাবিত করাও সম্ভব। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যকর ভূমিকা সংসদীয় কার্যক্রমে সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 

সংবিধান দেশের প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের সে প্রতিশ্রুতিকে অমান্য করে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা অবৈধ। তাই ব্যাপক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করেই রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। রেডিও-টেলিভিশনসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রচারমাধ্যমে সরকারের পক্ষপাতমূলক তথ্য প্রচার গণতান্ত্রিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। রেডিও-টেলিভিশনে জনগণ অবশ্যই জনগণের কথা শুনতে চায়। দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে জনগণের আস্থাভাজন ও শ্রদ্ধাভাজন ট্রাস্টিদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সম্প্রচার সংস্থা অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে। তখন দেশব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রচারমাধ্যমে নিজেদের প্রকৃত কথা শুনতে পাবে। 

বিগত দিনে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা অব্যাহত থাকলে এরই মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দৃঢ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতো। পৃথিবীর অনেক দেশ আরো কম সময়ের মধ্যেই নিজেদের অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলেছে। কিন্তু গত চার দশকেও আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য, মূল্যবোধ, চেতনা- এ আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বাংলাদেশের জনগণ আজও সংগ্রাম করে চলেছে। 

’৯০-এর গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ও সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ’৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার স্বৈরাচার ও রাজাকারকে সাথে নিয়ে পালাক্রমে দেশ শাসন করে চলেছে। দুই দলের নেতা-কর্মীরা পালাক্রমে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডার, দখলবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে। জনগণ অতীত বিএনপি জোটের দুর্নীতি দেখেছে। এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেয়ারবাজার লুট, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু ও বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি দেখেছে। দুই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা উপেক্ষিত। উভয় দলই পরিবারতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করে চলেছে। এরা একবার ক্ষমতা দখল করতে পারলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা-গুম-অপহরণ ও ক্রসফায়ার অব্যাহত আছে। প্রতিদিন পেট্রলবোমা ছুড়ে বাসে, ট্রাকে সাধারণ মানুষকে হত্যা, কথিত পুলিশ ও র‍্যাব কর্তৃক ক্রসফায়ার, নির্বাচনের পরপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যাকাণ্ড, কালশীতে বিহারি কলোনির হত্যাকাণ্ড, ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড খোদ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি। 

দেশের বাস্তব অবস্থা আজ এমন একপর্যায়ে উপনীত হয়েছে, মনে হয়, গুম খুন সন্ত্রাস, অবৈধ দখল ও দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে আর কোনো অপরাধ নয়। যে রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল- ছাত্র-যুবসহ জনগণের কল্যাণে, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা- সে রাজনীতি আজ পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিবিদদের অবৈধ অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের আয়ের চমকপদ হলফনামা থেকে তা সুস্পষ্ট। আমরা চাই— এসব কিছুর চির অবসান হোক। আমরা চাই না রুগ্‌ণ রাজনীতির কারণে আর একটি নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হোক। আমরা চাই না-রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকুক এবং ছাত্রদের আর একটি দিনও নষ্ট হোক। এ অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে সব ধরনের সন্ত্রাস ও সহিংস রাজনীতির চির অবসান ঘটাতে হবে এবং সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। 

‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’—সংবিধানের এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা অনুযায়ী শাসন সংক্রান্ত সব বিষয়ে জনগণের রায়ই চূড়ান্ত। তাই জাতীয় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে একমত হতে পারলে, গণভোটের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

যেহেতু ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং জনগণ সে ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে; নির্বাচন হতে হবে যেকোনো প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত, অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। তাই একটি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও স্বাধীন-শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য না ভোটের বিধান ও প্রতিনিধি প্রত্যাহারের ব্যবস্থাসহ নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করতে হবে। তাহলো-
১. জনগণের আস্থাভাজন, অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে ’৭২ সালে রচিত সংবিধানের মূলনীতির ভিত্তিতে সংবিধানের যুগোপযোগী সংশোধন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন, একই ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত না থাকা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখার স্বার্থে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুনীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশসনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।    

২. বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ জনপ্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং খাতে সততা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভূমি প্রশাসন ও জনপ্রশাসনকে সংস্কারের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ লাঘব এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক, জনস্বার্থের রক্ষক ও জনকল্যাণে নিয়োজিত একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

৩. দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানের সব দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে সম্পদ পাচার ও মানি লন্ডারিং কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। 

৪. শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করে অভিন্ন পদ্ধতির সার্বজনীন,গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক, বিনামূল্যে উপকরণ সরবরাহ ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। 

৫. সুলভমূল্যে কৃষি উপকরণ ও কম সুদে কৃষিঋণ খোদ কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষিকে লাভজনক পেশায় পরিণত করার লক্ষ্যে উৎপাদন খরচের সাথে যৌত্তিক মুনাফা নিশ্চিত করে কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। ঋণের দায়ের দরিদ্র কৃষক যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে কম মূল্যে কৃষি পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য না হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে।  কৃষিশ্রমিকদের জন্য সারা বছর কাজের নিশ্চয়তা ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় উৎপাদন অনুযায়ী কৃষিপণ্যভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের পরামর্শ, ঋণসহায়তা ও উৎসাহ দিতে হবে। গার্মেন্টসসহ সব শিল্প উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির উন্নয়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর এবং দলীয়করণ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। 

৬. কর্মস্থলে সব শ্রমিকের জন্য নিরাপদ অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, চাকরি ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা এবং জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা ও বাস্তবায়নসহ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য কর্ম, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও আশ্রয়লাভের সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। 

৭. জলবায়ু ও পরিবেশের প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ সব বর্জ্য আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করতে হবে।

৮. জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ, বন্দর-বিদ্যুৎসহ জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগকে সহায়তা এবং অভাবগ্রস্ত বিধবা, এতিম, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য অর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

আজ সর্বত্রই আমরা একই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি, আমরা কেন আন্দালন করে বারবার বিজয়ী হয়েও আন্দোলনের সফলতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা কেন এক সংকট থেকে আরেক সংকটে পতিত হচ্ছি? আমাদের ছাত্র ও যুবসমাজ কেন অতীতের মতো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে পারছে না? এত রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে যে দেশের জনগণ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে, সে দেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে, কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সংবিধান জনগণকে ‘সকল ক্ষমতার মালিক’ বলে ঘোষণা করেছে অথচ ক্ষমতাসীনরা তা ভুলে গিয়ে নিজেদের দেশের মালিক ভাবতে শুরু করেছে। এটা চরম স্বেচ্ছাচারিতা। 

দুই দশক ধরে বাংলাদেশে যত সহিংস রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে, যত জীবন ও সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, তার দায়ভার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন দুই জোটকেই নিতে হবে। দুই দশকের লুটপাট, দুঃশাসন ও রুগ্‌ণ রাজনীতি বারবার প্রমাণ করেছে যে এ দুই জোটের হাতে দেশ, জাতি ও জনগণ মোটেই নিরাপদ নয়। তাই, সুস্থধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দুই জোটের বিকল্প জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। তবে এ দুই জোটের মধ্যে যেসব প্রকৃত গণতন্ত্রমনা ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়ার সাথে শামিল হবেন— এখন সরকার সে কথা ভুলে গিয়ে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার হুমকি দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষৎকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। 

এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। রুগ্‌ণ রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। কার্যকর সংসদ, জবাবদিহিতামূলক সরকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অতীত আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে, ঐক্য জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য। এ জাতীয় সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় সংলাপ শুরু করার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে। 

রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত মালিক হিসেবে জনগণের কার্যকর ভূমিকা পালন করার ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সে লক্ষ্যে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করা। কেবল তখনই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে। তাই আসুন, কার্যকর গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে আমরা গণতান্ত্রিক মুক্তির পথে যাত্রা শুরু করি। 
 
ড. কামাল হোসেন : সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী